খাতায়-কলমে উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করছেন মন্ত্রীরা। সেই পরিকল্পনা কতটা কার্যকর হল, তা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্টও জমা দেবেন তাঁরা। কিন্তু সেই সব রিপোর্ট কতটা বাস্তব?
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, স্রেফ তথ্য দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করা যাবে না। মন্ত্রীদের দেওয়া রিপোর্টের ‘বাস্তবতা’ এ বার মাঠে নেমে যাচাই করবেন স্বয়ং তিনিই!
মঙ্গলবার গ্রামোন্নয়নে যুক্ত বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জানিয়েছেন তাঁর এই ‘প্রকল্প পরিদর্শন’ পরিকল্পনার কথা। কাজে গতি আনার কথা তিনি আগেই বলেছেন। আর এ দিনের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সেটা আবার মনে করিয়ে দিয়ে মমতার হুঁশিয়ারি, “উন্নয়ন পরিকল্পনায় কেন্দ্র ও রাজ্যের টাকা যেন কোনও মতেই পড়ে না-থাকে।”
চলতি অর্থবর্ষ শেষ হতে নতুন সরকারের হাতে আর সাকুল্যে সাত মাস। কিছু ‘করে দেখানোর’ জন্য তা যে যথেষ্ট নয়, মুখ্যমন্ত্রী তা বিলক্ষণ জানেন। তাই কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় দ্রুত কাজ শেষ করতে চান তিনি। সরকারি কাজ মানেই আঠারো মাসে বছর চালু এই ধারণার পরিবর্তনও ঘটাতে চাইছেন একই সঙ্গে। যার প্রেক্ষিতে বৈঠকে তিনি মন্ত্রীদের বলেছেন, “সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর, আর জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে দু’দফায় কোন কোন প্রকল্প, কবে শুরু করবেন, কবে শেষ করবেন, তার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিন উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দফতরে।”
তবে মমতা এখানেই থেমে থাকতে চান না। |
মন্ত্রীদের রিপোর্ট এবং তার বাস্তবায়নে অনেক সময়ে ফারাক থেকে যায়। আর এই সংক্রান্ত তথ্যে সামান্য অসঙ্গতিও যে তিনি মেনে নেবেন না, মমতা এ দিন তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে তথ্য দিয়ে পেশ করা রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে দেখতে প্রয়োজনে তিনি নিজেই জেলা সফর করবেন বলে মন্ত্রীদের এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তাঁর ইঙ্গিত, পুজোর পরে ওই সফর শুরু হতে পারে। কিন্তু মন্ত্রীদের রিপোর্ট যাচাই করতে মুখ্যমন্ত্রীর জেলায় যাওয়ার দরকার পড়ল কেন?
মহাকরণ-সূত্রের খবর: বৈঠকে বন দফতরের দেওয়া একটি তথ্য ঘিরে বিষয়টির সূত্রপাত। যাতে বলা হয়, গত ১৬ জুন থেকে এ পর্যন্ত গোটা রাজ্যে যে পাঁচ কোটি চারাগাছ বণ্টন ও রোপণের কথা, তার মধ্যে তিন কোটি বণ্টন-রোপণ হয়ে গিয়েছে। হিসেব শুনে ‘বিস্মিত’ ও ‘সন্দিগ্ধ’ মমতা বনমন্ত্রী হিতেন বর্মণকে বলেন ব্যাপারটা ভাল করে খতিয়ে দেখতে। এবং তার পরেই জানান, গ্রামোন্নয়নের কাজ কোথায় কতটা হল, এ বার তিনি নিজের চোখে তা যাচাই করতে চান। বস্তুত বৈঠক শেষে কয়েক জন মন্ত্রীও বলেন, উন্নয়নের প্রশ্নে তিনি যে কোনও অজুহাত মানতে নারাজ, মমতা এ দিন মন্ত্রীদের সামনে তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
আর নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে কাজ যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য মমতা সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন সমন্বয়ে। বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রীদের বলেছেন পরস্পরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতে। পাশাপাশি আশ্বাস দিয়েছেন, ভাল কাজের পথে অর্থ অন্তরায় হবে না। উল্লেখ্য, রাজ্যের অনগ্রসর এলাকার নানাবিধ উন্নয়নে যোজনা কমিশন প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তা পেতে হলে কেন্দ্রের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প জমা দিতে হবে। যোজনা কমিশন তা পরীক্ষা করে টাকা দেবে।
পদ্ধতিগত এই বিষয়টিই এ দিন মন্ত্রীদের আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে প্রকল্পের ফাইল উন্নয়ন-পরিকল্পনা এবং অর্থ দফতর হয়ে মুখ্যসচিবের কাছে যাতে সময়ে পৌঁছয়, মন্ত্রীদের সে দিকে সতর্ক নজরও রাখতে বলেছেন। কারণ, মুখ্যসচিবই সব চূড়ান্ত করে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য দিল্লিতে পাঠাবেন। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের আহ্বান, “পদ্ধতি সরল করে বুঝতে হলে দরকারে ফাইল নিয়ে সরাসরি আমার কাছে চলে আসুন।”
এ দিকে মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বৈঠকে জানান, রাজ্যের সেচ, ক্ষুদ্রসেচ, বন ও মৎস্য দফতরের কাজকে একশো দিনের কাজের আওতায় আনা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ওই প্রকল্পে ১ এপ্রিল থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ১৮ দিন। খরচ হয়েছে প্রায় ছ’শো কোটি টাকা। শুনে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, “আমাদের বদনাম ঘোচাতে হবে। দেখবেন, সব টাকা যেন ঠিকঠাক খরচ করা যায়।”
আরও বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠেছে বৈঠকে। এবং মুখ্যমন্ত্রী সব ক্ষেত্রেই জোর দিয়েছেন ‘দ্রুততা’র উপরে। সুন্দরবনে বাঁধ নির্মাণের কাজ আরও তাড়াতাড়ি শুরু করার পক্ষপাতী তিনি। আয়লা-ধ্বস্ত সুন্দরবনে বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণ একটা সমস্যা হলেও যে জমি হাতে আছে, সেখানেই কাজ শুরু করে দিতে চান তিনি। যোজনা কমিশনের প্রস্তাবিত ‘জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন’-এর জন্য এক জন অধিকর্তা নিয়োগের কথা হয়েছে। কৃষিকাজ, গো-সম্পদ বা গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্পের প্রসার ঘটিয়ে গ্রামীণ মানুষের উপার্জনের সুযোগ বাড়ানো হবে এতে। শুখা মরসুমে ডাঙা জমিতেও যাতে চাষ করা যায়, সে জন্য ‘জল ধরো-জল ভরো’ প্রকল্পের সুষ্ঠু ও দ্রুত রূপায়ণে গুরুত্ব দিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। বনাঞ্চলে যথেচ্ছ কাঠ চুরির খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে নির্দেশ দেন অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার।
এ দিনের বৈঠকে কৃষি, সেচ, বন, গ্রামোন্নয়ন, উদ্যানচর্চা, মৎস্য, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, জলসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদি গ্রামোদ্যোগ দফতরের মন্ত্রী-সচিবেরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন অর্থমন্ত্রীও। আজ, বুধবার নগরোন্নয়ন সংক্রান্ত দফতরগুলির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করবেন। |