অমর সিংহকে সংসদ-ঘুষ কাণ্ডে শেষ পর্যন্ত জেলেই যেতে হল! আর দুর্নীতির প্রশ্নে কংগ্রেসের অস্বস্তিও এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গেল।
২০০৮ সালে ঘুষের বিনিময়ে ভোট কাণ্ডে আজ গ্রেফতার করা হয় সাংসদ অমরকে। টু জি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী এ রাজা, সাংসদ কানিমোজি বা কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারিতে সুরেশ কলমডী যে জেলে আছেন, সেই তিহাড়ই ঠিকানা হল রাজ্যসভার এই সাংসদের। অথচ অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আজ গোড়ায় আদালতেই আসতে চাননি প্রাক্তন এই সমাজবাদী নেতা। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হাজিরা তো দিতে হয়ই, নাকচ হয়ে যায় জামিনের আবেদনও। তিস হাজারি আদালতে বিশেষ বিচারক সঙ্গীতা ধিংড়া সেহগল তাঁকে ১৩ দিনের জন্য জেলে রাখার নির্দেশ দেন। ঘুষ কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দুই প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ ফাগ্গন সিংহ কুলস্তে এবং মহাবীর সিংহ ভাগোরাকেও জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা আজ কংগ্রেসকে চাপে ফেলছে, তা হল ইউপিএ-র প্রথম জমানায় আস্থা ভোটের সময় কেন ঘুষ দিয়ে সাংসদ কিনতে চেয়েছিলেন এই ঠাকুর নেতা? কার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য? বিজেপি, বাম-সহ তামাম বিরোধীরা এই প্রশ্নই তুলেছেন। সন্দেহ নেই, দুর্নীতি প্রশ্নে কংগ্রেসকে আক্রমণের জন্য তাদের অস্ত্র আজ আরও ধারালো হয়েছে, যা দৃশ্যতই অস্বস্তিতে ফেলেছে কংগ্রেসকে।
তবে এখানেই শেষ নয়। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, ঘুষ কাণ্ডের তদন্তের আঁচ এ বার কংগ্রেসের গায়ে সরাসরি লাগতে পারে। বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালতের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে যে ভাবে তদন্ত চলছে, তাতে কংগ্রেস-নেতাদের নাম উঠে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। শেষ পর্যন্ত তা ঘটলে কংগ্রেসের বিড়ম্বনা নিঃসন্দেহে বাড়বে। কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন বলে এড়িয়ে গেলেও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী পবন বনশল দাবি করেছেন, “জেতার জন্য ওই তিন বিজেপি সাংসদের ভোট দরকার ছিল না ইউপিএ-র। সরকার কত ভোটে জিতেছিল, তা দেখলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।” |
শীর্ষ আদালত সক্রিয় হওয়ার কারণেই তিন বছর আগের ঘটনা নিয়ে নতুন করে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। নইলে চলতি ধারণা ছিল, হয়তো বা ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে ঘুষের বিনিময়ে ভোট নিয়ে তদন্ত। ২০০৮ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারের আস্থা ভোটের সময় তৎকালীন বিজেপি সাংসদ কুলস্তে, ভাগোরা, আর্গল লোকসভায় তাড়া তাড়া নোট দেখিয়ে অভিযোগ করেন, টাকা দিয়ে তাদের ভোট কিনতে চাওয়া হয়েছে, এবং পুরো ঘটনার পিছনে রয়েছেন তৎকালীন সমাজবাদী পার্টি নেতা অমর। ঘুষ দিতে চাওয়ার ঘটনাটি গোপন ক্যামেরায় তোলাও হয়। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পরেই এ ঘটনার তদন্তে নড়েচড়ে বসে সিবিআই। অমর সিংহ, তার কয়েক জন সঙ্গী এবং কুলস্তেদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। চার্জশিট দেওয়া হয়েছে লালকৃষ্ণ আডবাণীর প্রাক্তন সহকারী সুধীন্দ্র কুলকার্নির নামেও। তাঁরও এ দিন আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর কৌঁসুলি জানান, সুধীন্দ্র বর্তমানে আমেরিকায়। তিনি আদালতের সমনও পাননি। এই ঘটনায় বিজেপি সাংসদ অশোক আর্গলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া এবং তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারের অনুমতি আগেই চেয়েছে সিবিআই।
তবে আজ সকাল থেকে নাটকের মূল চরিত্র ছিলেন একদা বড়বাজার এলাকার কংগ্রেস নেতা অমর সিংহই। তাঁর কৌঁসুলি আসগর খান আদালতে বলেন, সম্প্রতি অমরের দুটো কিডনিই প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এবং তিনি কিডনির সংক্রমণে ভুগছেন। ফলে তাঁকে আদালতে হাজিরা থেকে রেহাই দেওয়া হোক। বিচারক এ ব্যাপারে সবিস্তার মেডিক্যাল রিপোর্ট চান। অমরের কৌঁসুলি এ জন্য দু’দিন সময় চাইলেও পাননি। বিচারক এ দিন বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যেই তা জমা দিতে বলেন। তার ঘণ্টাখানেক পরেই আদালতে চলে আসেন অমর। আগাম জামিনের আবেদন করে মেডিক্যাল রিপোর্ট দেন অমর। বলেন, “আমি ধার করা কিডনিতে বেঁচে আছি। এবং আমার মূত্রনালীতে সংক্রমণও হয়েছে, যা প্রতিস্থাপিত কিডনির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।”
কিন্তু সেই মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখে বিচারক বলেন, ২০১০ সালের অক্টোবরের পর থেকে মেডিক্যাল রিপোর্ট কোথায়? অমর জানান, তা দিতে সময় লাগবে। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে অমর অন্তর্বর্তী জামিনের যে আর্জি করেছেন, ৮ সেপ্টেম্বর তার শুনানি হবে।
অমরের জেল-যাত্রার খবর আদালত থেকে সংসদ পৌঁছতে সময় লাগেনি। তার পর সংসদ চত্বরে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসকে পূর্ণ উদ্যমে আক্রমণ শুরু করেন বিরোধীরা। সিপিএম পলিটব্যুরো নেত্রী বৃন্দা কারাট বলেন, “অমর সিংহ কার হয়ে কাজ করছিলেন, সেটাই তদন্ত করতে হবে। অমর সিংহ তো সরকারের মাথা ছিলেন না। এটা সবাই জানে যে সাংসদদের টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা হয়েছিল।” আর অমরের জেলযাত্রাকে কটাক্ষ করে সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তর মন্তব্য, “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।” অমর সিংহকে বহিষ্কার করলেও সমাজবাদী পার্টির তরফে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ দিন বলা হয়, অমর সিংহকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে। আর ওই ঘটনার সময়ে লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “যা ঘটেছিল, তা খুবই লজ্জার। দেরি হলেও আইন তার নিজের পথেই চলবে বলে আশা করছি।” প্রাক্তন স্পিকার জানান, সেই সময় তিনি ওই সাংসদদের ঘরে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তাঁরা তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি জানাননি? তা হলে পুলিশ ডাকা যেত।”
বিজেপি মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন বলেন, “অমর সিংহকে জেলে পাঠানোর মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে ঘুষ দেওয়া হয়েছে। বিজেপি এটাই গোড়া থেকে বলে আসছে। কিন্তু ফগ্গন সিংহ খুলাস্তের মতো যাঁরা বিষয়টি ফাঁস করলেন, তাঁদেরও সমান চোখে দেখাটা ঠিক নয়। এটা ম্যাচ ড্র করার চেষ্টা। বরং আসল দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া উচিত।” বিজেপি-র দুই প্রাক্তন সাংসদ গ্রেফতার হওয়ায় কিছুটা অস্বস্তি তাঁদেরও রয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগে দেশের আরও চার জন এখন তিহাড়ে। ডিএমকে-র কানিমোঝি এবং এ রাজা, কংগ্রেসের সুরেশ কলমডী ও ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা নির্দল সাংসদ মধু কোড়া। কিন্তু অমরের তিহাড়-যাত্রা বিশেষ ভাবে অস্বস্তিতে ফেলেছে গোটা সংসদকেই।
লোকপাল গঠন নিয়ে অণ্ণা হজারের অনশন থেকে শুরু করে সংসদের ভিতরে-বাইরে যাবতীয় বিতর্কের লক্ষ্য একটাই, সরকারি উচ্চ পদে দুর্নীতি দমন। অথচ আইন ও বিচার মন্ত্রকের যে স্থায়ী কমিটি লোকপাল সংক্রান্ত বিভিন্ন বিলের খসড়া খতিয়ে দেখবে, তারই অন্যতম সদস্য অমর। ওই কমিটি পুনর্গঠন করা হলেও অমরের থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কারণ, প্রত্যেক সাংসদই অন্তত একটি করে সংসদীয় কমিটিতে থাকার অধিকারী। দলহীন সাংসদ অমর নিজে থেকে সরতে না চাইলে তাঁকে জোর করে কমিটি থেকে সরানো যাবে না।
সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি-দমনকারী লোকপাল গঠনের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভাবে থেকে যাবেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে তিহাড়বাসী। |