যে খাবার দেয়, পেট ভরে না। তাই বেশি করে জল খাই।
খাবার চেয়ে নিস না কেন!
চাইলে ওরা বলে, যা দিয়েছি খেয়ে উঠে যাও। বেশি কথা বললে এটাও পাবে না।
অনাথ বালকের ফ্যাকাশে চোখ মুখে অদ্ভুত আতঙ্কের ছায়া। নিচু গলায় কথা বলার সময়ও কাঁপছিল সে। যেন জ্বর এসেছে। বালক জানায়, বাইরের কাউকে এ সব জানানো বারণ। কেউ শুনতে পেলে তাকে বার করে দেবে।
ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম ব্লকের কামাখ্যাগুড়ি এলাকায় সরকারি আর্থিক সাহায্যে বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত ‘তপোবন’ নামে মানসিক প্রতিবন্ধী হোমের আবাসিকদের পরিস্থিতি। ওই হোমে অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ৯ দিনে ৪ জন আবাসিকের মৃত্যু হয়েছে। গত দেড় মাসে মৃত্যু হল ৫ জনের। এ ছাড়া আরও আট জন গুরুতর অসুস্থ হয়েছে। তাদের মধ্যে ছ’জনকে কামাখ্যাগুড়ি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। পরে তিনজনকে কোচবিহার সদর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে শনিবার এক জনের মৃত্যু হয়। বাকি তিন জনকে হোমে রেখে চিকিৎসা চলছে। ওই ঘটনার পরে আবডালের বেড়াজাল ভেঙে পড়ে। ১৯৯৬ সালে ‘ক্রেডা’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সমাজ কল্যাণ দফতরের অর্থ সাহায্যে গড়ে ওঠা হোমের কদর্য পরিচালন ব্যবস্থা স্পষ্ট হতেই হইচই শুরু হয়। ক্ষুব্ধ এলাকার বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি হোমের পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দু’শো আবাসিকের থাকবার ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে ওই হোমে অনাথ এবং মানসিক প্রতিবন্ধী মিলিয়ে রয়েছে ৯৩ জন ছেলেমেয়ে। গত ২১ জুলাই সেখানে ডলি (২২) নামে এক আবাসিক অসুস্থ হয়। বমি এবং পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। ওই দিনই তাকে কামাখ্যাগুড়ি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে রাতে মারা যায়। এর পর বুবাই (১৩) নামে আরও এক আবাসিককে ২৪ অগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পরের দিন মারা যায়। ২৯ অগস্ট অসুস্থ হয় ভানু এবং সোমা নামে দুই মানসিক প্রতিবন্ধী। হাসপাতালে নেওয়ার পথে ভানুর মৃত্যু হয়। সোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করবার পর বুধবার রাতে মারা যায়। শনিবার মৃত্যু হয় নেহা নামে ১৪ বছরের এক কিশোরীর। বর্তমানে আরও আট জন অসুস্থ আছে। কামাখ্যাগুড়ি ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু ঠাকুর বলেন, “তপোবনের আবাসিকরা অপুষ্টিতে ভুগছে। ওদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।” কুমারগ্রামের বিডিও বীরবিক্রম রাই বলেন, “অত্যন্ত উদ্বেগজনক ঘটনা। অপুষ্টির জন্য চিকিৎসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে ওই হোমে যাব।” কিন্তু প্রশাসনের কর্তা ও স্বাস্থ্য আধিকারিকরা অপুষ্টির সমস্যাকে চিহ্নিত করলেও হোম কর্তৃপক্ষ তা মানছেন না। হোম সুপার বকুল আর্য উল্টে ‘নিছকই দুর্ঘটনা’ বলে বিষয়টি চালানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর দাবি, “গত পাঁচ বছরে আবাসিকদের এ ভাবে অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। একজন আবাসিকেরও মৃত্যু হয়নি। এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল।” কিন্তু হোম কর্তৃপক্ষের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন কামাখ্যাগুড়ি নাগরিক মঞ্চের সভাপতি ননীশঙ্কর পাল। তিনি বলেন, “গত ১৫ অগস্ট ওই হোমের আবাসিকদের ফল ও মিষ্টি দিতে গিয়েছিলাম। ওই দিনই বুঝতে পেরেছি আবাসিকরা ভাল অবস্থায় নেই। সেখানে বিনোদন, পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। হোম জুড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আবাসিকরা অপুষ্টিতে ভুগছে।” নাগরিক মঞ্চ আবাসিকদের মৃত্যুর ঘটনার তদন্তের দাবি করেছে। তাঁদের অভিযোগ, হোম কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতিতে সেখানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অন্তত ৯ জন অসুস্থ হয়েছে। বিবেকানন্দ ক্লাবের বাপি সাহা বলেন, “উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীকে হোমের ঘটনা জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানানো হবে।” জেলা সমাজ কল্যাণ আধিকারিক সুরেন্দ্র প্রসাদ ভগত বলেন রবিবার ওই হোম পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, “হোমের পরিকাঠামো ভাল নয়। এতগুলি মৃত্যুর কথা কর্তৃপক্ষ জানাননি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।” |