যে ভাল করে লেখাপড়াটা করতে চায়, তার কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আর কোনও কিছু ভাবনাচিন্তা করার দরকার নেই, প্রথম দু-তিন বছর ভাল করে লেখাপড়াটা করে যাওয়া ব্যস্। তার প্রথম কাজ নিজের বিষয়টা ভাল করে পড়া এবং ‘প্রমিসক্যুয়াসলি’ পড়া, মানে একেবারে কোনও বাছবিচার না করে সব কিছু পড়া। যেমন, যদি কেউ সাহিত্যের ছাত্র হয়, তবে সে হাতের কাছে চণ্ডীমঙ্গল পেলেও পড়বে, মপাসাঁ পেলেও পড়বে। সব পড়বে। সব কিছু পড়ার একটাই সুযোগ। এই সুযোগটা জীবনে আর আসবে না। বিশেষ করে সাহিত্য, ইতিহাস, এই রকম কিছু বিষয়ে এত বই নির্বিচারে পড়ে ফেলতে হয় যে সে আর বলবার নয়। মোটা মোটা উপন্যাস, বোরিং সমস্ত মহাকাব্য মহাকাব্য মানে ‘এপিক’ বলছি না, এই ধরো পাস্টোরাল পোয়েট্রি হতে পারে, কিংবা নাটক আমি তো ছাত্রাবস্থায় আর্লি মডার্ন পিরিয়ডের নাটক কত যে পড়েছি তার শেষ নেই, সব পড়তে হবে। সব।
আসলে এই হচ্ছে সুযোগ, যখন একেবারে এলোপাথাড়ি ভাবে লেখাপড়া করা যায়। এক দিকে বিষয়টা শিখতে হবে, যেমন ভাবে অঙ্ক শিখি, ফিজিক্স শিখি, কেমিস্ট্রি শিখি। অন্য দিকে চার পাশের অনেক কিছু পড়ে ফেলতে হবে। এই দু’বছর তিন বছর আমাদের সেই চাপটা নেই, যেটা পরে এসে পড়বে, যখন থিসিস করব বা অন্য কিছু, তখন আর এই সুযোগটা এ ভাবে পাওয়া যাবে না। আসলে পরে মনটা আর তৈরি করা যায় না। মনটা তৈরি করতে চাইলে ওটাই তার সময়। অন্য করাও কথা শোনার দরকার নেই, জাস্ট পড়ে যাও।
আমাদের প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়ার অভিজ্ঞতার একটা উদাহরণ দিই। প্রথম দিন ক্লাসে এসে মাস্টারমশাই বললেন, ‘গ্রিক ট্র্যাজেডি পড়েছ?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার, পড়েছি।’ তখন বললেন, ‘সব ক’টা সোফোক্লেস পড়ে আসবে, সব ক’টা ইস্কিলাস পড়ে আসবে, সব ক’টা ইউরিপিডিস পড়ে আসবে।’ মানে পরের সপ্তাহে আমাকে সাতাশটা নাটক পড়ে যেতে হবে। এবং এগুলো কিন্তু কোনওটাই সিলেবাসে নেই। এগুলো চাপিয়ে দেওয়া হল, এবং চাপিয়ে দেওয়া হল এমন জিনিস, যেগুলো আমি কিন্তু পরে আর পড়ব না। মানে, তোমার যদি নিজের থেকে ভাল না লাগে, তা হলে তোমাকে এগুলো বাকি জীবনে আর পড়তে হবে না। সেই জন্যই এখন, এই প্রথম ক’টা বছর, যত পারো, পড়ে ফেল। এই সুযোগটা পরে আর পাবে না। এটা যে যতটা কাজে লাগাতে পারবে, ততই তার লাভ।
যদি বলো, সিলেবাসের কী হবে? আমি বলব, সিলেবাস উইল টেক কেয়ার অব ইটসেল্ফ। যারা লেখাপড়া করে আনন্দ পায়, তারা ভাল করবেই, কেউ তাদের আটকাতে পারবে না। সিলেবাস যতই লম্বা হোক, যতই ওজনদার হোক, ঠিক পরীক্ষার আগে লেখাপড়া করে তারা বেরিয়ে যাবে। যেমন তারা স্কুলে করেছিল, কলেজেও তেমনটাই করবে। কলেজের কাজটা হচ্ছে বিষয়টা শেখা, সিলেবাসটা শেখা নয়। এটা যারা মনে রাখতে পারে, তাদের চিন্তার পরিধিটাও প্রসারিত হয়, তারা কুয়োর মধ্যে পড়ে থাকে না। |