ভাল প্রশ্ন থেকেই শেখার শুরু
ভারতবর্ষ অনেক প্রাচীন দেশ হলে হবে কি, দেশটা ঠিক কেমন, কোথায় কোথায় তার নদী-পাহাড়-উপত্যকা রয়েছে, কী তাদের মাপজোক, তা বোঝার কাজটা শুরু হয়েছিল মাত্র বছর দুশো আগে, ১৮০২ সালে। ত্রিকোণমিতির টেকনিক কাজে লাগিয়ে গোটা দেশটার মানচিত্র তৈরির কাজটা মোটেই সহজ ছিল না - বহু পরিশ্রমে দিনে-রাতে মাপজোক করতে হত, ভয় ছিল বাঘ, ম্যালেরিয়া, ডাকাতের খপ্পরে পড়ার। সেই সঙ্গে কষতে হত ভয়ানক জটিল সব অঙ্ক। এত তোড়জোড়, খরচ, কষ্ট দেখে অনেকে অবাক হয়ে বলত, ‘এত কাণ্ড করে মানচিত্র তৈরি করে হবেটা কি? কোথাও যেতে হলে কী করে যেতে হবে, সেটা পালকির হেড বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।’
সেই কথাটা মনে পড়ে যায় যখন শুনি, ‘ক্লাস করে হবেটা কী, কোচিং-এ পড়লেই তো পাশ করা যায়।’ আমাদের দেশে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা ব্যাপারটা চেনা-জানা রাস্তা দিয়ে গিয়ে চেনা জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার মতোই। গোটা কতক বছরের গোটা কতক প্রশ্ন জানা থাকলেই উতরে যাওয়া যায়। এমনকী আই আই টি, মেডিক্যাল কলেজের মাস্টারমশাইরাও দুঃখ করেন, একবার ছাত্ররা ঢুকে গেলে আর পড়াশোনা করতে চায় না। পরীক্ষায় পাশ তো করবেই, পড়ে হবেটা কী? জানার, বোঝার, আয়ত্তে আনার যে বিশাল জমি পড়ে রয়েছে, তা তিল তিল করে চেনার কষ্ট, আবিষ্কারের আনন্দ, এ দুটোই অধরা থেকে যায়। এ যেন রাজার বাড়ি নেমন্তন্নে এসে ঝালমুড়ি খেয়ে বাড়ি ফেরা। শাহি বিরিয়ানি, গোস্ত রোগনজোশ বানিয়ে যে বসেছিল, অতিথির হাতে মুড়ির ঠোঙা দেখে সে যেমন হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলে, আমাদের শিক্ষকদের দশাও এখন তেমন।
কী করে শিক্ষার হাল ফেরানো যায়, কেমন করে আমাদের কলেজ-ইউনিভার্সিটি বিশ্বের যে কোনও সেরা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, তা নিয়ে এ রাজ্যে চিন্তা শুরু হয়েছে। সেই চিন্তার গোড়াতেই এসেছে শিক্ষকদের কথা - সেরা শিক্ষকদের খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে। ভাল শিক্ষক কে? এম আই টি-তে অর্থনীতির অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁদের মাস্টারমশাই নবেন্দু সেন এক দিন ক্লাসে পড়িয়েছিলেন, কেন অর্থনীতির ইতিহাস পড়া দরকার। ‘অন্য শিক্ষকদের মতো তিনি আমাদের বইয়ে কী লেখা আছে সেটা বলেননি। তিনি যা পড়াচ্ছেন তা কেন পড়াচ্ছেন, সেটা বুঝিয়েছিলেন।’ বই পড়ানোর বাইরে গিয়ে, বিষয়টা কেন জরুরি, কেন উপভোগ্য সেটা বোঝানো, এটাই অভিজিৎবাবুর মতে ভাল শিক্ষকের কাজ।
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী
এম আই টি-হার্ভার্ডের মতো সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাসে যাঁরা বসেছেন, তাঁরা টের পেয়েছেন যে শিক্ষকের কাজটা ঝাঁপান-বাহকের নয়, বরং ট্যুর গাইডের। ছাত্র যেখানে যাবে বলে বেরিয়েছে, শিক্ষক তাকে প্রায় কোলেপিঠে করে সেখানে পৌঁছে দেবেন, এটা আশা করাই ভুল। তাঁর ভাবটা বরং এই রকম, ‘অমুক এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছে, তমুক ওই রাস্তা দিয়ে। আমি অবশ্য এই কোনওটা দিয়েই না গিয়ে এই রাস্তাটা দিয়ে গিয়েছি, কিন্তু ওই ওদিকটায় কী আছে এখনও দেখা হয়নি।’ এ বার ছাত্র খুঁজে নিক, কোনটা তার পছন্দের। নতুন রাস্তা যে বার করতে পারবে, সবচেয়ে বেশি পিঠ-চাপড়ানি জুটবে তার। আগের পাঁচজনের দেখানো পথে সাত-তাড়াতাড়ি যে পৌঁছে যাবে, আসল খেলায় সে থাকবে পিছিয়ে। এমনকী গন্তব্যও ঠিক করতে পারে ছাত্র নিজেই - অনেক মাস্টারমশাই ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেওয়ার সময় তিন-চারটি প্রশ্ন দিয়ে বলে দেন, ‘এর বাইরেও যে কোনও প্রশ্ন তুমি ঠিক করে নিতে পারো।’ তুমি কী জানো, শেষ অবধি সেটা কথা নয়। তুমি কী পারো, কথা হল সেটাই। তেমন ভাল না জানলে তেমন কিছু করতে পারবে না, তাই পড়তে তোমাকে হবেই।
আমাদের পড়াশোনার বেশির ভাগটা জুড়ে থাকে উত্তর লেখা। যত দ্রুত, যত টু-দ্য-পয়েন্ট উত্তর লেখা যায়, তত নম্বর। ও দেশের পড়াশোনায় অনেক জরুরি হল প্রশ্ন করা। বিষয়টা যখন পড়া হচ্ছে ক্লাসে, তখন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নগুলো কে করতে পারছে, মাস্টারমশাইরা তা লক্ষ রাখেন, তাদের নম্বরও দেন সে জন্য। লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রেও, মাস্টারমশাইয়ের দেওয়া প্রশ্নটি প্রায়ই একটি বড় এলাকা নির্দেশ করে কয়েকটি বিতর্ক তুলে দেয়। ছাত্রকে তার মধ্যে নিজের প্রশ্ন তৈরি করে নিয়ে তার উত্তর লিখতে হয়। প্রশ্নটা যত মোক্ষম হবে, উত্তরও হবে তত ভাল। পড়াশোনার একটা ধারণায় কোয়েশ্চেন পেপার হল রেললাইন -- তার উপর দিয়ে পড়াশোনা চলে। এ দিক ও দিক হল তো বেলাইন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার ভয়। অন্য ধারণায় এক একটা প্রশ্ন হল এক একটা চাবি। তা দিয়ে দরজা খুলে যায়, তারপর যে যতদূর ইচ্ছে যেতে পারে।
আমাদের ক্লাসরুমে পড়ানো হয় বই। শিক্ষক বইয়ে কী বলা হয়েছে, ছাত্রদের তা বোঝান। লেখকের বক্তব্য ভাল করে বুঝে নেওয়াই ছাত্রদের কাজ। ওদেশের ক্লাসরুমে পড়ানো হয় বিষয়। গোটা তিন-চার বই বা পেপারের কিছু নির্দিষ্ট অংশ পড়ে ক্লাসে আসতে হয়। ‘পড়ানো’ জিনিসটা বস্তুত হয় একটা আলোচনা - কোনও একটি প্রশ্নে মাস্টারমশাই কী ভাবছেন, ছাত্ররা কী ভাবছে, যাদের বই পড়া হয়েছে সেই লেখকরা কে কী ভাবছে, কোন কথায় কে গলা মেলাবে, কে কিছুতেই রাজি হবে না - এইগুলো থেকে মতামতের মানচিত্রটা তৈরি করাই ক্লাসরুমের কাজ। প্রশ্ন করা এখানে ‘ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার’ সেই তাগিদ ঠিক নয়। ‘আপনার বোঝাটা ঠিক হয়নি, অন্য ভাবে বুঝলে আরও ভাল হত’ কিংবা ‘যা বোঝা গিয়েছে তাতে অমুকটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না,’ - এমন চ্যালেঞ্জটাই মাস্টারমশাইরা চান। আর এই সব প্রশ্ন আর উত্তর যখন ঘরময় ছোটাছুটি করে টেনিস বলের মতো, তখন ক্লাসগুলো এক একটা লাইভ ম্যাচ হয়ে যায়। ভয় হয়, এই বুঝি ক্লাস শেষ হয়ে গেল।
ছাত্রের প্রশ্ন করা মাস্টারমশাইয়ের কাছেও জরুরি, বলছিলেন পিটার ডায়মন্ড। গত বছর নোবেল পেয়েছেন অর্থনীতিতে এম আই টি-র এই অধ্যাপক, তাঁর সম্মানে অর্থনীতি বিভাগ পার্টি দিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা রীতিমত সুটেড-বুটেড হয়ে উপস্থিত। পিটার কিন্তু ইস্ত্রিহীন চেক-কাটা শার্ট, ঢোলা প্যান্ট আর স্নিকার পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরজার সামনে, কেউ ঢুকলেই সহাস্যে হ্যান্ডশেক করছেন, যেন তাঁরই মেয়ের বিয়ে। ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে গোড়াতেই পিটার বললেন ছাত্রদের কথা। “তারা প্রশ্ন না করলে বহু কথা আমার মাথাতেই আসত না,” বললেন তিনি। ক্লাসের আলোচনার সূত্রেই এসেছে এ যুগের সেরা উদ্ভাবনী চিন্তা। ভাল প্রশ্ন নইলে ভাল আবিষ্কার, ভাল তত্ত্ব তৈরি হয় না। মনটা খুলতে না পারলে বই খোলার মানে হয় না, ক্লাসে সেটাই শেখে ভাল ইউনিভার্সিটির ভাল ছাত্ররা।
শেখে সেমিনারেও। ‘শক অ্যান্ড অ’ জিনিসটা কী, সেটা বুঝতে চাইলে গালফ ওয়ারের ভিডিয়ো দেখলে কেবল হবে না, বসতে হবে ও দেশের সেমিনারে। আমাদের সেমিনারগুলো কেমন ভদ্র-সভ্য, শান্তশিষ্ট। বক্তা বেশ নিরুদ্বেগে বেশির ভাগ সময়টা ধরে কথা বলেন, বাকি পনের-কুড়ি মিনিটে তিন-চারটি প্রশ্ন আসে, গোটা ব্যাপারটা বেশ সৌজন্যের ফয়েলে মোড়া। যে কেউ মাইক ধরা মানে মিনিট চল্লিশ নিশ্চিন্দি। মাঝেমাঝেই কেমন মনে হয়, ঢোকার সময়ে ফাইল-পেন বিলি না করে ফুঁ-দিয়ে-ফোলানো বালিশ দিলেই তো হত। আর ও দেশের সেমিনারে কথা মাটিতে পড়তে পায় না। দুটি-বাক্য অন্তর একটি প্রশ্ন, এমনকী ‘এই আমার পেপারের শিরোনাম’ বললেই দু-তিনজন তেড়েফুঁড়ে হাত তুলে প্রশ্ন শুরু করে দেয়। আর সে সব প্রশ্ন কী, বক্তা-বেচারির খ্যাতি-পদমযার্দার বর্ম ভেদ করে একেবারে বক্তব্যের মর্মস্থলে বেঁধে। মুহূর্তে মুহূর্তে হাত ওঠে, আছড়ে পড়ে প্রশ্নের গ্রেনেড। এ দেশে ও সব প্রশ্নের এক আধখানা কেউ করলে সেম-সাইড করার অপরাধে কবে একঘরে করে দিত সকলে। ‘অমুকটা বলা মানে মোটেই তমুকটা বলা নয়’ বলে বাগড়া দেওয়াটা মোটেই এখানে ভদ্রদস্তুর নয়।
ক্লাস টেনের এক ছাত্রীকে চিনতাম, সে শিক্ষিকার ব্যাখ্যা ঠিক কি না সন্দেহ প্রকাশ করলে তিনি পালটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুই দিদিমণি না আমি দিদিমণি?’ অভিজিৎবাবু মনে করেন, এই মনোভাবটাই মারাত্মক। ‘আমাদের দেশে প্রশ্ন করলে মানুষ রাগ করে কেন, বুঝি না। কারওকে প্রশ্ন করা মানে তো তাকে সম্মান করা।’ দুঃখের বিষয়, আমাদের ক্লাসরুমে, আর ক্লাসের বাইরেও, চ্যালেঞ্জ করাকে অসম্মান করা বলেই ধরা হয়।
সম্প্রতি প্রশ্ন না-করার বদভ্যাসটাকে খুব সুন্দর তুলে ধরেছে একটি চলচ্চিত্র: ‘থ্রি ইডিয়টস।’ ইম্পিরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সব মাস্টারমশাই র্যাঞ্চোকে (আমির খান) এত অপছন্দ করত, কারণ সে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করত তাঁদের। ভাল শিক্ষক শেষ অবধি কে -- র্যাঞ্চো, যে একদিন ক্লাস করানোর সুযোগ পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, বইয়ের বাইরে চিন্তা না করলে উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না? নাকি প্রিন্সিপাল ‘ভাইরাস,’ যে পড়াশোনার বাঁধা মডেলের বাইরে পা রাখতেই নারাজ? এখনও অবধি ভাইরাসই জিতে রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ মনে হয় আসবে র্যাঞ্চোর দখলে। যতদিন ভারত বিদেশে তৈরি যন্ত্রপাতি, ওষুধ, সফটওয়্যার আরও সস্তায় আরও দ্রুত বানাতে চেয়েছে, ততদিন বইয়ের বাঁধা বিদ্যা কাজে দিয়েছে।
কিন্তু ভারত যদি সত্যি বিশ্বে নেতৃত্বের জায়গায় আসতে চায়, তা হলে দলে-ভেড়ার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে নতুনের সন্ধানে নামতে হবে। তখন দরকার হবে এমন ছাত্র, যারা নোটস তৈরি না করে প্রশ্ন তৈরি করে। আর এমন শিক্ষক, যিনি ছাত্রদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন উত্তরের সন্ধানে। তা হলে এখনই শুরু করতে দোষ কী? অন্তত ক্লাসগুলো এত বোরিং হবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.