|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
পশ্চিমব্যঙ্গ! |
অবশেষে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ই বহাল। কেন? না, ইহা উত্তরাখণ্ড-এর চেয়ে উচ্চারণ করা সহজ। অন্তত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত তেমনই। কিন্তু যাহা সহজ, তাহাই কি শ্রেয়? তবে কিনা রাজ্যের বিবিধ প্রান্ত হইতে লোকেরা আসিয়া তাঁহাকে বলিয়া গিয়াছেন পশ্চিমবঙ্গই তাঁহাদের পছন্দ। উপরন্তু সর্বদলীয় ঐকমত্যে রাজ্যের এই নাম ধার্য হইয়া গিয়াছে। যাঁহারা নাম-পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, তাঁহাদের তো আগেই জবাব দেওয়া হইয়াছে যে, বিভিন্ন জাতীয় সম্মেলনে বা আলোচনাচক্রে ইংরাজি ডব্লিউ-খচিত আদ্যাক্ষরের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নিজের বক্তব্য পেশ করার জন্য ডাক পায় সকলের শেষে। বর্ণানুক্রমিক এই বন্দোবস্তে বেশ কয়েক ধাপ উপরে উঠিতেই এই নাম-বদল। এ ধরনের কোনও তাগিদ কি কখনও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের তরফে অনুভূত হইয়াছে? রাষ্ট্রপুঞ্জ বা অনুরূপ আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিতে আগে বক্তব্য পেশ করার ডাক পাওয়ার তাগিদ থাকিলে ইউ এস এ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অনায়াসে আপনাকে আমেরিকায় রূপান্তরিত করিতে পারিত, ইউনাইটেড কিংডম নিজেকে ব্রিটেনে। সে ক্ষেত্রে বর্ণানুক্রমিক তালিকার এক ও দুই নম্বর স্থানটি এই দুই দেশের দখলেই থাকিত। কিন্তু বর্ণানুক্রমে অগ্রগামিতাকে কখনও সভ্য দুনিয়া গুণগত উৎকর্ষ বা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি গণ্য করে নাই। পশ্চিমবঙ্গের সর্বদলীয় ঐকমত্য যদি ওই ছদ্ম অগ্রগামিতার মায়ায় এতই মুগ্ধ, তবে তো রাজ্যটির নাম ‘বঙ্গ’ কিংবা ‘বঙ্গভূমি’ রাখিলেই চলিত, সে ক্ষেত্রে এক লাফে আরও অনেক ডাল উপরে উঠিয়া যাওয়া যাইত। আর নামটি যদি হইত ‘আমরা বাঙালি’, তবে তো অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচলপ্রদেশ ও অসমকে পিছনে ফেলিয়া একেবারে শীর্ষের মগডালেই পা ঝুলাইয়া বসিয়া থাকা যাইত। তাহাতে রাজ্য-রাজনীতিতে এমনকী ‘আমরা-ওরা’র বিভেদপন্থাও মন্ত্রবলে ঘুচিয়া যাইত। কেননা সকলেই ‘আমরা’ হইয়া গেলে ‘ওরা’ বলিয়াও আর কিছু থাকে না। সর্বদল কেন যে ইহা ভাবিয়া দেখিল না!
এখন অবশ্য সেই সুযোগও হাতছাড়া, আর কিছু করার নাই। কেননা বিধানসভায় নূতন নামটি প্রস্তাবাকারে অনুমোদিত হইয়া গিয়াছে, কেবল রাষ্ট্রপতির সম্মতির অপেক্ষা। ইংরাজিতে পশ্চিমবঙ্গ না বলিয়া ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’-ই থাকিয়া গেলে অবশ্য বাঙালির সাম্প্রতিক ইতিহাসটি তাহাতে বিধৃত থাকিত। বাঙালির ইতিহাসসিদ্ধ দ্বিভাষিকতার প্রতিও সুবিচার করা হইত। বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা বটে, কিন্তু ইংরাজিও একই ভাবে বাঙালির ভাষা। ইংরাজি বাঙালিকে দিয়াছে মননের, জ্ঞানচর্চার, পঠন-পাঠনের মাধ্যম আর উদার বিশ্বদৃষ্টি। দেশের আর কোনও রাজ্যের এই গৌরব এতখানি নাই। ওয়েস্ট বেঙ্গল নামটির মধ্যে দ্বিভাষিকতার যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নিহিত, তাহার জঠর হইতেই বাংলার নবজাগৃতি-- রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের উন্মেষ। কিন্তু সস্তা জনমনোরঞ্জনের রাজনীতি এই গৌরব অনুধাবন করিবে কেমন করিয়া? দ্বিভাষিকতার মহিমময় অলঙ্কারটি বাঙালির অঙ্গ হইতে কাড়িয়া লওয়াতেই তাহার স্বস্তি। তাহার প্রমাণ বারে-বারেই মিলিয়াছে। দ্বিভাষিকতার বিরোধী এই মানসিকতাই একদা রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা হইতে ইংরাজি তুলিয়া দিয়া একটা কাজের-কাজ করার তৃপ্তি অনুভব করিয়াছিল। পশ্চিমবঙ্গকে ইংরাজি ‘পি’ অক্ষর দিয়া লিখিবার মধ্যেও মাতৃভাষা-প্রেমের অন্তরালে বিদেশি ভাষার আধিপত্য রদের সেই উগ্র প্রাদেশিকতার মনোভাব প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে, এমন একটি অনুমান করিলে ভুল হইবে না বোধহয়। |
|
|
|
|
|