সম্প্রতি নতুন ভবন হয়েছে। হয়েছে নতুন রং। ঝকঝকে ভবন বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, পরিষেবা নিয়ে এলাকাবাসীর এত ক্ষোভ থাকতে পারে।
কিন্তু সিউড়ি ২ ব্লকের অবিণাশপুরে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ক্ষেত্রে এটাই সত্যি। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা নিয়ে ক্রমশই ক্ষোভের পারা চড়ছে এলাকায়। অভিযোগ, চিকিৎসক ‘অসুস্থ’ হওয়ায় গত তিন দিন ধরে বন্ধ আছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগটি। শুধু তাই নয়, অন্তর্বিভাগের শিশু, পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডের জনৈক চিকিৎসকও টানা ডিউটি করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দু’দিন ধরে কার্যত গোটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রই চলছে নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভরসায়।
বীরভূমের উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ১ (ডিসিএমওএইচ-১) অরুণলাল মণ্ডল বলেন, “ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে দু’জন চিকিৎসক ছিলেন, তাঁরা অসুস্থ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পাড়ুই থানার অন্তর্গত এই অবিণাশপুর (সুলতানপুর) ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে ৬টি পঞ্চায়েত এলাকার মানুষ নির্ভরশীল। |
জরুরি ও অন্তর্বিভাগ (পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড) মিলিয়ে মোট ১৫টি শয্যা রয়েছে। এ ছাড়া শিশু ওয়ার্ডেও কয়েকটি শয্যা আছে। শয্যা কোনও সময়েই খালি থাকে না। উপরন্তু প্রতিনিদিই রোগী ভর্তির চাপ। সকাল থেকে দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত বহির্বিভাগে রোগীরা আসেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, অনেক সময়েই চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না। এই এলাকায় গত সপ্তাহে ডায়েরিয়ার ব্যাপক প্রকোপ ছড়িয়েছিল। সে কারণে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে রোগীর চাপ সেই সময় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অন্তর্বিভাগের চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, প্রাক্তন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক পড়াশোনার জন্য দিন পনেরো আগে ছুটি নেওয়ায় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বর্তমানে স্থায়ী ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক নেই। পুরন্দরপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে অবিণাশপুরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনিও পুরন্দরপুর ছেড়ে বেশির ভাগ সময়েই অবিণাশপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে পারেন না। ফলে মূলত দু’জন চিকিৎসকের ভরসাতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছিল।
শুক্রবারও স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে গিয়ে দেখা মেলেনি ইন্দ্রজিৎবাবু বা অন্য দুই চিকিৎসকের। সেখানেই দেখা পাওয়া গেল স্থানীয় তাজোলা গ্রামের বাসিন্দা সামসুল হোদার। গত সোমবার থেকে তাঁর আত্মীয় নুরুন্নিসা খাতুন জ্বরের উপসর্গ নিয়ে এখানে ভর্তি রয়েছেন। সামসুলের অভিযোগ, চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছেন না। একই অভিযোগ ভুলিপুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ মোজেসর আলির। পেটের অসুখ নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি তাঁরও আত্মীয়। |
বললেন, “গত দু’দিন ধরে কোনও চিকিৎসক নেই। কী ভাবে কী হবে, বুঝতে পারছি না।” দূরশঙ্কা গ্রামের বাসিন্দা মন্টু শেখ, সামসুন্নেহা বিবিরা বলেন, “এ দিনও সকাল থেকে চতুর্থ স্রেণির কর্মীরাই বহির্বিভাগ খুলে রেখেছিলেন চিকিৎসক আসবেন বলে। দুপুর পর্যন্ত আমরা ঠায় অপেক্ষা করেছি। কোনও চিকিৎসকই আসেননি।”
এই অবস্থায় রোগী ও তাঁদের পরিজনদের ভরসাস্থল এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্সেরাই। বনশঙ্কা এলাকার রুহুল আমিনও পেটের গণ্ডগোলের উপসর্গ নিয়ে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি রয়েছেন। তাঁর কথায়, “নার্সরা না থাকলে এত দিনে হয়তো মরেই যেতাম! কোনও রকমে ওষুধপত্র দিয়ে ওঁরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন আমার মতো অনেক রোগীকে।” স্থানীয় বাসিন্দা শেখ ইশাক জানান, বৃহস্পতিবার এক অস্তঃসত্ত্বা বধূ প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। কোনও চিকিৎসক ছিলেন না। নার্সেরাই তাঁর ‘ত্রাতা’ হয়ে দাঁড়ান। ফলে কোনও অঘটন ঘটেনি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্তব্যরত নার্স আলেয়া সিদ্দিকিও মেনে নিলেন যে, পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্গীন। তাঁর কথায়, “এক চিকিৎসক টানা কাজ করে ও রোগী দেখতে দেখতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই মুহূর্তে কোনও চিকিৎসকই নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কোনও রকমে রোগীদের সেবা-শুশ্রূষা চলছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তবে আমাদের তো সীমাবদ্ধতা রয়েছে।”
এ দিকে, ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী আসা কমছে না। এক নার্স বললেন, “মাঝে মাঝে কী ভাবে সামাল দেব বুঝতে পারছি না। অন্তঃসত্ত্বার দিকে নজর দিতে গেলে জরুরি বিভাগ ফাঁকা পড়ে থাকছে। আবার জরুরি বিভাগের দিকে যখন যাচ্ছি, তখন পুরুষ বা মহিলা ওয়ার্ড থেকে রোগীর আত্মীয়েরা চলে আসছেন ডাকতে।” তাঁরা জানিয়েছেন, বর্তমানে পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে ১৬ জন রোগী ভর্তি। শিশু ওয়ার্ডেও একটিও শয্যা খালি নেই।
এই অবস্থায় কোনও রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কী ভাবে সামাল দেবেন, আপাতত সেই আশঙ্কা মাথায় নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন নার্সেরা। |
ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। |