চূড়ান্ত ‘বিভ্রান্তি’ বিধানসভায়
‘অখণ্ডতা’ এবং মোর্চার দাবি রেখেই পাশ হল জিটিএ বিল
গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসনকে ‘প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক’ ক্ষমতা দেওয়ার আশ্বাস অন্তর্ভুক্ত করেই বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল জিটিএ বিল। একই সঙ্গে রাজ্যের ‘সুরক্ষা ও নিরাপত্তা’র পাশাপাশি ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করার আশ্বাস দিল রাজ্য সরকার। বিলের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, “বাংলা ভেঙে যাবে, বলা খুব সহজ! কিন্তু সেটা হবে না। আমরা বাংলা ভাঙতে দেব না!”
সরকার নিজেই গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসন (জিটিএ), ২০১১ বিলটিতে ৫৪টি সংশোধনী এনেছে। কিন্তু এতগুলি সংশোধনী সমেত নতুন বিল পাশ করাতে গিয়ে শুক্রবার বিধানসভায় প্রায় আড়াই ঘণ্টার আলোচনায় নজিরবিহীন ‘বিভ্রান্তি’ এবং ‘বিশৃঙ্খলা’ দেখা দিয়েছে। কখনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খারিজ করে-দেওয়া সংশোধনী পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মেনে নিয়ে আবার মোর্চার আপত্তিতে খারিজ করেছেন। কখনও সরকারি পক্ষের বিধায়কেরা সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়ে ‘না’ বলে ফেলেছেন।
জিটিএ বিল পাশের পরে উচ্ছ্বাস দার্জিলিঙে। শুক্রবার। ছবি: রবিন রাই
তাতে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে হয়েছে, এই ভাবে যেন বিধানসভাকে ‘বিভ্রান্ত’ করা না-হয়। কখনও একই সংশোধনী দু’বার করে পাশ করানো হয়েছে। কখনও বিরোধীদের সংশোধনী নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা পার্বত্য বিষয়ক দফতরের মন্ত্রী মমতা বক্তৃতা করে দেওয়ার পরেও খোদ পরিষদীয় মন্ত্রী-সহ একাধিক মন্ত্রী সভায় অভিযোগ করেছেন, বিরোধীদের সংশোধনী প্রস্তাবের প্রতিলিপি তাঁদের হাতে নেই। অথচ বাকি বিধায়কদের হাতে সেই প্রতিলিপি বহু আগেই বিলি করা হয়ে গিয়েছে।
গোটা ঘটনার জেরে দিনের শেষে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র কার্যত বলতে বাধ্য হয়েছেন, “এত বিভ্রান্তি হল যে, কোন সংশোধনী গৃহীত হল আর কোনটা হল না, তা-ই বোঝা গেল না! ওঁরা (সরকার) হ্যাঁ-কে না, না-কে হ্যাঁ বললেন! সংশোধনী-সহ বিধানসভার ছাপানো নথি পাওয়ার আগে কিছু বলা মুশকিল!”
তবে রাজ্য সরকারের পক্ষে ‘স্বস্তি’র কথা, পাহাড়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির অন্যতম পক্ষ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে ‘খুশি’। বিল নিয়ে আলোচনা চলাকালীন বিমল গুরুঙ্গের ‘দূত’ হিসাবে বিধানসভার গ্যালারিতে এ দিন উপস্থিত ছিলেন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি। পরে তিনি বলেন, “সংশোধনী এনে যে ভাবে বিলটি গৃহীত হয়েছে, তাতে আমরা খুশি।” তার আগে বিল নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে মোর্চার বিধায়ক হরকা বাহাদুর ছেত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সদিচ্ছা দেখিয়েছেন পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে। গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি আমরা ছাড়িনি এবং চুক্তিতে তা লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের আশা, এই সভাও গোর্খাদের যথার্থ দাবিকে স্বীকৃতি দিতে তার দায়িত্ব পালন করবে।” হরকা পরে এ-ও বলেছেন, প্রতিশ্রুত ‘ক্ষমতা’ না-পেলে তাঁরা আবার আন্দোলনের পথে যাবেন।
• জিটিএ-র জন্য প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা।
• রাজ্যের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার আশ্বাস।
• জিটিএ থেকে ‘সভা’ বাদ।
• তরাই-ডুয়ার্স নিয়ে কমিটির কাজ চলবে।
• সরকারেরই ৫৪টি সংশোধনী।
• খুশি মোর্চা। তবে ক্ষমতা না-পেলে আন্দোলন।
• বিরোধীদের সিলেক্ট কমিটির দাবি খারিজ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিন মূলত দু’টি প্রশ্নে বিরোধী বামফ্রন্টের আশঙ্কা দূর করার চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, রাজ্যের ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার কথাটি স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, পাহাড় বা রাজ্যের কোথাওই ‘বিভেদ’ সৃষ্টি তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়ত, তরাই-ডুয়ার্সের এলাকা জিটিএ-র আওতায় ঢুকবেই, এমন ‘প্রচার’কে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “কাকে কান নিয়ে গেল বলে কাকের পিছনে দৌড়বেন না! ত্রিপাক্ষিক চুক্তির সময় থেকেই ভুল বোঝানো হচ্ছিল যে, তরাই-ডুয়ার্স দিয়ে দেওয়া হবে (জিটিএ-কে)। কিন্তু এখনও তো সিদ্ধান্তই হয়নি। শ্যামল সেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়া হয়েছে। তারা এখন সব দিক খতিয়ে দেখছে। আমরা মনে করি, পাহাড় ভাই আর তরাই-ডুয়ার্স বোন! দার্জিলিং আমাদের প্রাণ, তরাই-ডুয়ার্সও আমাদের প্রাণ!”
মোর্চার দাবি মেনেই মূলত বিলে এ দিন একগুচ্ছ সংশোধনী এনেছে সরকার। মোর্চার আপত্তি মেনেই গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসন চালানোর জন্য নির্বাচনের পরে যে সংস্থা গঠিত হবে, তার নাম থেকে ‘সভা’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। বিলের যাবতীয় ধারা-উপধারা থেকে ‘সভা’ শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য সংশোধনী এনেছেন সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। গোর্খার দাবি মেনেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতার (এগ্জিকিউটিভ) পাশাপাশি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা জিটিএ-কে দেওয়ার কথা বিলে উল্লেখ করেছে সরকার। লেপচা, মেচ, ভুটিয়াদের মতো পাহাড়ের আদি বাসিন্দাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা কেন বিলে নেই, কেনই বা তফসিলি জাতি, উপজাতি-সহ অন্যান্য জায়গায় স্বীকৃত সংরক্ষণের কথা নেই, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন বামফ্রন্টের বিধায়কেরা। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, ৪৫ জনের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে যে সংস্থা তৈরি হবে, তারা বিষয়টি মাথায় রাখবে। রাজ্যপালের হাতে যে ৫ জন সদস্য মনোনীত করার অধিকার থাকবে, তার মধ্যেও এই অংশের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকবে। মুখ্যমন্ত্রীর আরও আশ্বাস, লেপচাদের জন্য একটি উন্নয়ন পর্ষদ করার কথা সরকার বিবেচনা করবে। প্রসঙ্গত, যে সব দাবিতে লেপচাদের সংগঠন কলকাতায় ধর্না-অবস্থান করছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
বামফ্রন্টের তরফ থেকে ১৪টি সংশোধনীর প্রস্তাব আনা হয়েছিল। তার মধ্যে সরকারের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় একটি গৃহীত হয়েছে, বাকিগুলি নয়। যদিও মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধীদের ৪-৫টি সংশোধনী মানা হবে। বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বিল নিয়ে আলোচনায় বলেন, পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন যাতে আরও ‘শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত’ হতে পারে, তার জন্য তাঁরা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতেই চান। কিন্তু তরাই-ডুয়ার্স অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব বিবেচনার বিষয়টি তাঁরা মানতে পারছেন না। ওই বিষয়ে বামেদের সংশোধনী অবশ্য ভোটাভুটিতে খারিজ হয়ে যায়। আরও একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন’ তুলেছিলেন সূর্যবাবুরা। সংশোধনী এনে সরকার জিটিএ বিলে পঞ্চায়েত সমিতির পাশাপাশি জেলা পরিষদের কথা অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু সংবিধানের সংস্থান অনুযায়ীই পাহাড়ে জেলা পরিষদ নেই বলে জানান সূর্যবাবু। সেখানে আছে মহকুমা পরিষদ। তা হলে কী ভাবে জেলা পরিষদ ঢুকবে, প্রশ্ন তোলেন বিরোধী দলনেতা। পরিষদীয় মন্ত্রী সরাসরি তাঁর যুক্তি গ্রাহ্য বা খারিজ না-করে বলেন, “সংবিধানে যা আছে, সেই অনুযায়ীই ব্যবস্থা হবে।” বস্তুত, সংশোধনীতে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-র বদলে সরকার পক্ষ বারবার ‘সংবিধানে যা আছে, তা-ই হবে’ বলার জন্যই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
সরকারের বিস্তর সংশোধনী দেখে ‘বিভ্রান্তি’ এড়ানোর জন্য বিরোধী দলনেতার প্রস্তাব ছিল, বিলটি এই অবস্থায় পাশ না-করে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। তারা ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। কিন্তু পরিষদীয় মন্ত্রী সেই প্রস্তাব খারিজ করার কথা জানিয়ে দেন গোড়াতেই। সূর্যবাবু পরে বলেন, “সিলেক্ট কমিটি হলে সব প্রশ্নই সেখানে বসে আলোচনা করে মিটিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু তা না-করায় এত বিভ্রান্তি থেকে গেল!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.