নতুন সরকার এসেই সরকারি পরিবহণে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এ বার রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের অধীনে থাকা সংস্থাগুলির কর্মীদের বেতন, পেনশন-সহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রেও শুরু হয়ে গেল রাশ টানা।
সম্প্রতি কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (কেআইটি)-সহ নগরোন্নয়ন দফতরের অধীনে থাকা ন’টি সহযোগী সংস্থাকে সরকারি অনুদানের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকা চলবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকারি সংস্থাগুলিকেও বেসরকারি সংস্থার মতোই পেশাদারী দক্ষতায় চলতে হবে। সে ক্ষেত্রে নিজেদের পড়ে থাকা সম্পদকেই কাজে লাগিয়ে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের ঘাড়ে যেমন কিছুটা হলেও ব্যয়ভারের বোঝা লাঘব হবে, তেমনই সরকারি সংস্থাগুলিও ‘আলসেমি’ ছেড়ে আয় বাড়ানোর কথা ভাববে। কারণ কেআইটি-র মতো বড় সরকারি সংস্থাও আর্থিক ভাবে এতটাই পঙ্গু হয়ে গিয়েছে যে, তাদের ১১০০ কর্মীর বেতন এবং ৯০০ অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর পেনশন দেওয়ার আর্থিক দায় নগরোন্নন দফতরকেই মেটাতে হচ্ছে। কিন্তু এ বার থেকে এই ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে আর ‘গৌরী সেন’ হয়ে থাকতে চাইছে না রাজ্য সরকার।
সম্প্রতি সল্টলেকে কেএমডিএ-র সদর দফতরে হলদিয়া, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আসানসোল, মেদিনীপুর-খড়গপুর উন্নয়ন পর্ষদের মতো ন’টি সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “ভর্তুকি দিয়ে আর সরকারি সংস্থাগুলিকে চালানো যাবে না। সে কারণেই নগরোন্নয়ন দফতরের অধীনস্থ সংস্থাগুলিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” সরকার বড়জোর বিভিন্ন রকম প্রকল্পের বরাত দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে।
আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হওয়ায়, বহু বছর ধরেই সিটিসি, সিএসটিসি-সহ অন্যান্য সরকারি পরিবহণ সংস্থাগুলি ধুঁকছে। অবস্থাটা অনেকটা এ রকম, মোট পাঁচটি সরকারি পরিবহণ সংস্থায় কর্মীদের বেতন দিতে বছরে ৪৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ ভর্তুকি দিতে হয় রাজ্য সরকারকে। বামফ্রন্ট আমলে ওই সংস্থাগুলিকে খরচ কমিয়ে আয় বাড়ানোর কথা বলা হলেও কখনওই ভর্তুকি তুলে দেওয়ার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ফলে আয় বাড়ানোর উপায় থাকলেও, সরকারি ভর্তুকি পাওয়াই সংস্থাগুলির অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
এই সরকারি নির্ভরতা ব্যবস্থাটিই ভেঙে ফেলতে চাইছে রাজ্যের নতুন সরকার। আর তাতে যে কাজ হচ্ছে তার প্রমাণও মিলছে। সম্প্রতি সিটিসি-র চেয়ারম্যান শান্তিলাল জৈন ফতোয়া জারি করেছেন, উচ্চপদস্থ কর্তারা ছাড়া আর কেউ সরকারি অর্থে ভাড়ার গাড়ি চড়তে পারবেন না। এত দিন ওই সংস্থায় এমন অনেকেই ছিলেন যাঁদের পদাধিকার বলে গাড়ি পাওয়ার কথা না থাকলেও, বছরের পর বছর তাঁরা সরকারি অর্থে গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
একই ভাবে সরকারের অন্যান্য সহযোগী সংস্থাগুলিও আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হওয়ায় চেষ্টা না চালিয়ে পুরো আর্থিক দায় রাজ্য সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে বসে থেকেছে। যে কারণেই নগরোন্নয়ন দফতর ভর্তুকির পরিবর্তে কেআইটি-কে বস্তি উন্নয়নের প্রকল্পের বরাত দিয়ে তাদের রোজগার বাড়ানোর পথ তৈরি করে দিচ্ছে। পাশাপাশি, কলকাতার মধ্যে কেআইটি-র যে সমস্ত জমি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, সেখানে বহুতল আবাসন বা বাণিজ্যিক অফিস বাড়ি তৈরি করে তা ভাড়া দিয়ে আয় বাড়ানো যায় কি না সে ব্যাপারেও ভাবনা শুরু হয়েছে। পুরমন্ত্রী অবশ্য এ নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি।
মেদিনীপুর-খরগপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা মেদিনীপুরের বিধায়ক মৃগেন মাইতি জানিয়েছেন, পর্ষদের জন্য নগরোন্নয়ন দফতরকে বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হয়। কারণ পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতে বাড়ির নকশা অনুমোদন করে তাদের নিজস্ব আয় চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি হয় না। আয় বাড়িয়ে নিজেদের আর্থিক দায় এখন থেকে নিজেদেরকেই মেটানোর কথা বলা হয়েছে বলে তিনি জানান।
কেআইটি, কেএমডিএ-র মতো সংস্থাগুলির জন্য বছরে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা নগরোন্নয়ন দফতরকে বরাদ্দ করতে হয় বলে জানিয়েছেন দফতরের প্রধান সচিব দেবাশিস সেন। তবে এই টাকাকে ভর্তুকির বদলে সরকারি ভাষায় ‘প্ল্যান ফান্ড’ বা পরিকল্পিত তহবিল বলেই বলেই ব্যখ্যা করা হয়ে থাকে। ওই তহবিলের পুরো টাকাটাই উন্নয়নের বদলে স্বশাসিত সংস্থাগুলির আর্থিক দায় মেটাতেই ফুরিয়ে যায়। যা ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার পথেই হাঁটতে চলেছে রাজ্য সরকার। |