দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিখরচায় কোচিংয়ের ব্যবস্থা করল মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন। এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে এগিয়ে এসেছেন ছাত্র, শিক্ষক, বধূ থেকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীও। ক’দিনেই এই উদ্যোগ সাড়া ফেলে দিয়েছে। যা দেখে অভিভূত স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা মেদিনীপুর সদরের মহকুমাশাসক সুরজিৎ রায়। তিনি বলেন, “সর্বত্রই যাতে এই ধরনের উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষও যাতে এ ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আমরা সেটা চাই। তা হলে গরিব ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবার প্রকৃতই উপকৃত হবে।”
রোজ বিকেলে স্কুলের সামনে জনাকয়েক বন্ধুর সঙ্গে গল্পগুজব করতেন সেচ দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী নেপালচন্দ্র দাস। দিনভর বাড়ির কাজ সামলে বাড়িতেই পরিচারিকার ছেলেমেয়েদের পড়াতেন কুইকোটার বধূ নীলিমা ভট্টাচার্য। স্কুলের পাশেই মেসে থাকেন পদার্থবিদ্যায় এমএসসি পাঠরত সোমনাথ মহাপাত্র। স্কুলের পক্ষ থেকে এঁদের কারও কাছেই কোনও আবেদন করা হয়নি। ওঁরা নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন। পারিশ্রমিক ছাড়াই। কেন? ছাত্র সোমনাথের কথায়, “আমিও গরিব বাড়ির ছেলে। কত কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হচ্ছে তা তো বুঝতে পারি। সেই উপলব্ধি থেকেই এগিয়ে আসা।” নীলিমাদেবীর কথায়, “স্বামী ব্যবসা করেন। আমি সারাদিন বাড়িতে বসে টিভি দেখে সময় নষ্ট করে কী করব! যদি সমাজের একটু উপকারে লাগি। আমার বাড়ির কাজের মেয়ের ছেলেমেয়েদের পড়াতাম। তারাই বলল, এ রকম একটি কোচিং সেন্টার হয়েছে। অমনি চলে এলাম।” অবসরপ্রাপ্ত নেপালবাবুর কথায়, “বসে বসে গল্পগুজব করার থেকে যদি কারও উপকারে লাগতে পারি, ক্ষতি কী?” এ ভাবেই নিখরচায় পড়ানোর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মতোই ভূমিকা পালন করছেন শহরের এক ব্যবসায়ী রথীন রায়ও। ব্যবসার অবসরে চলে আসেন পড়াতে। সকলের প্রচেষ্টায় নিখরচার স্কুলও এখন তাই সরগরম। |
বহিরাগতরা স্বেচ্ছায় এসেছেন পড়াতে। তবে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উপর নির্দেশ জারি করেছেন কর্তৃপক্ষ। এক জন করে পড়ুয়াকে নিয়মিত এখানে পড়াতে আসতে হবে। তাতে আপত্তি নেই কারও। স্কুলেরই নবম শ্রেণির ছাত্র ঋষি মুন্দ্রা জানাল, “পড়াতে ভালই লাগে।” স্কুলের শিক্ষিকাদের অবশ্য বাধ্যবাধকতা নেই। তবু বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতনের প্রধান শিক্ষিকা চন্দা মজুমদার নিয়মিত আসেন। স্কুল শেষ করে বাড়ি ফিরেই ফের স্কুলে আসতে অসুবিধা হয় না? চন্দাদেবীর উত্তর, “যে কাজ সমাজের উপকারে লাগবে তার জন্য এটুকু করব না। এটা কষ্ট বলে মনেই হয় না।” স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক প্রবীর সরখেলের কথায়, “ছাত্রছাত্রীদের আসা আবশ্যিক করার পিছনে কয়েকটি যুক্তি রয়েছে। ছাত্র নিজে শিক্ষকের ভূমিকায় থাকলে নিজের পড়াটাও ভাল করবে। দ্বিতীয়ত, অল্প বয়স থেকেই সমাজের প্রতি কিছু করার দায়বদ্ধতা জাগবে। ভবিষ্যতে আরও বড় কিছু করার প্রেরণাও পেতে পারে অনেকে।” এ রকম নানা চিন্তাভাবনা থেকেই বছর দুই আগে তৎকালীন জেলাশাসক নারায়ণস্বরূপ নিগম এই ধরনের কোচিং সেন্টার খোলার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে। বর্তমান জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তও এ বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে তাড়া দিতে থাকেন। অবশেষে গত ২৩ জুলাই কোচিং সেন্টার চালু হয়। বর্তমানে সেন্টারে ছাত্র সংখ্যা ৯২ জন। বরিশাল কলোনির অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শেখ হোসেন বলেন, “বাবা ট্রলি চালায়। আমরা খুব গরিব। কোচিং পেয়ে খুব উপকার হচ্ছে।” একই কথা পঞ্চম শ্রেণির সৌম্যদীপ মাদ্রাজিরও। সে বলে, “বাবা কারখানায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। নিখরচায় পড়ার সুযোগ পেয়ে খুব উপকার হচ্ছে।” আপাতত লোয়ার নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোচিং শুরু হয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন, দেড় ঘণ্টা করে। ছাত্রছাত্রীদের টিফিনও দেওয়া হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, আরও ছাত্রছাত্রী আসতে চাইছে। কিন্তু সবাইকে নেওয়ার সামর্থ্য নেই। মহকুমাশাসক বলেন, “সরকারি ভাবে যদি কিছু সাহায্য মেলে বা কোনও সহৃদয় ব্যক্তি যাতে সাহায্য করতে পারেন, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” |