ম্যাচটা লিখতে গিয়ে সাতাত্তরের কসমস ম্যাচ চলে আসছে। আরও ভাল করে বললে পেলে ম্যাচ।
সেই ম্যাচে মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন ছিলাম বলে বলছি না। আজ ৩৪ বছর পরেও মনে হয় পেলে ম্যাচ মোহনবাগানের ২-১-এ জেতা ম্যাচ। শেষ দিকে সুধীরের (কর্মকার) ট্যাকলে পেলে পড়ে গিয়ে হাত তুলতেই রেফারি লক্ষ্মীনারায়ণ ঘোষ থতমত খেয়ে পেনাল্টি দিয়ে দিয়েছিলেন। পেলে বলে কথা! সেখান থেকেই ম্যাচ ২-২ হয়ে যায়। ম্যাচ শেষে ফুটবল সম্রাট আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ওটা পেনাল্টি ছিল না। কসমস ম্যাচের কথা আনলাম অন্য কারণে। আজ দ্বিতীয়ার্ধে যখন বক্সের বাঁ-দিক থেকে বিখ্যাত সোলো রানটা মেসি করল এবং ফাইনাল ট্যাকলে বিলবোর্ডের কাছে ছিটকে পড়লসবাই ভেবেছিল হাত তুলে পেনাল্টির আবেদন করবে। করলে হয়তো রেফারি দিয়েও দিতে পারত। কোথায় কী! মিনিটখানেক মতো চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা, তার পর কিছুক্ষণের জন্য দু’হাতে হাঁটু জড়িয়ে বসা। আর তার পর তুমুল অভিনন্দনের মধ্যে সম্রাটের মতো উঠে ফের মাঠের দিকে হেঁটে যাওয়া। প্লে-অ্যাক্টিংয়ের বালাই নেই। নিজের মেগাস্টার ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করে রেফারির উপর চাপ সৃষ্টি করা নেই। এটাই মেসি। |
টাচ আর স্কিলের যুগলবন্দি দেখব বলে যুবভারতীতে গিয়েছিলাম। যা দেখলাম, মন ভরে গিয়েছে। মেসি যে নিজের পুরোটা দেবে এবং নব্বই মিনিট মাঠে থাকবে প্রিভিউয়ে লিখেছিলাম। দেখলাম খুব একটা ভুল ভাবিনি। ম্যাচের ফল ৩-১, আবার ১-৩-ও হতে পারত। কিন্তু ফলাফলে কী এসে যায়? মানুষ যুবভারতীতে গিয়েছিল ফুটবলের রাজপুত্রকে দেখতে। রাজপুত্রের বাঁ-পা যুবভারতীতে উজাড় করে দিল যাবতীয় মণিমুক্ত। বিশ্বের সেরা ফুটবলার, স্বভাবতই আকাশছোঁয়া ছিল প্রত্যাশা। সোলো রানে অবিশ্বাস্য গোল হয়নি, এমনকী বাঁ পায়ে নেওয়া স্বপ্নের ফ্রিকিকটাও সাইড নেটে ধাক্কা খেয়েছে। তবু চোখ ভরে দেখলাম মেসি-ম্যাজিক। একটা খচখচানি শুধু থেকে গেল। দ্বিতীয়ার্ধে মেসির মারা ফ্রি-কিকটা থেকে যে কেন গোল হল না! হলে একেবারে ষোলো কলা পূর্ণ হত। |
দুটো টিম, বাইশ জন মাঠে ছিল। কিন্তু প্রতিভা তো তার জাত আলাদা করে চেনাবেই। আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা বলেই তো প্রতিভা! আর তার বিচ্ছুরণ তো হবেই! ম্যান মার্কিং দিয়ে যে মেসিকে আটকানো যায় না সেটা বিশ্ব ফুটবলে কারও জানতে বাকি নেই। অন্য রাস্তাটা ছিল জোনাল মার্কিং। রাজপুত্রকে আটকাতে ২০১০ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অদ্ভুত একটা ছক নিয়েছিলেন তখনকার ইন্টার মিলান কোচ হোসে মোরিনহো। পরে বলেছিলেন, মেসি আর গোলপোস্টের মাঝখানে একটা গোটা এরোপ্লেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ম্যাচে আটকে গিয়েছিল মেসি। কিন্তু মোরিনহোর রিয়াল আর সেসার ফারিয়াসের ভেনেজুয়েলা এক নয়। তাই প্রতিভা তার ঝলকানি দিল বারবার। একক দক্ষতায় ভেঙেচুরে দিল ভেনেজুয়েলার রক্ষণ। মেসি যখনই বল পেয়েছে, বুঝিয়ে দিয়েছে ও আলাদা। অন্য রকম। বাকিদের মতো নয়।
ম্যাচটার কথা বললে প্রথমেই বলব, একটা টিম যে স্রেফ ছোট ছোট পাস খেলে একটা ম্যাচ বার করে নিয়ে যেতে পারে, এই ম্যাচ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। কখনও দেখলাম দশ গজের বৃত্তর মধ্যে খেলা হচ্ছে বারো থেকে চোদ্দোটা পাস। বল আকাশে তুলে ম্যাচের গতি বা ছন্দ নষ্ট করা নেই। বরং ছোট ছোট নিখুঁত পাসে গোলমুখ খোলার একটা চেষ্টা। যা চোখকে আরাম দেয়। দেখতে ভাল লাগে। ইগুয়াইনের কথা অনেক শুনেছিলাম। কিন্তু মেসির বাড়িয়ে দেওয়া যে বলে ভলিটা নেটে রাখত পারল না , সেটা আদৌ ওর সুনামের পক্ষে বলছে না। বড় স্ট্রাইকার এ সব ক্ষেত্রে দশ বারে সাত বার গোল করবে। |
সাবেইয়ার কোচ হিসেবে অভিষেকটা জয় দিয়ে। কিন্তু বাতিস্তার উত্তরসুরিকে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে। ধরে নিচ্ছি এই দলটার নিউক্লিয়াসই ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপে খেলবে। অন্তত ছ’সাত জন তো থাকবেই। সাবেইয়ার কিন্তু ডিফেন্সে দু’একটা স্তম্ভ দরকার হবে। ডেমিসেলিস, অতামেন্দি, বুর্দিসোদের দিয়ে চলবে না। ডিফেন্সে এত ফাঁকফোকর কেন? ভেনেজুয়েলা অন্তত তিন বার নীল-সাদা ডিফেন্সকে একেবারে হাট করে দিয়েছিল। ভেনেজুয়েলা বলে সাবেইয়া বেঁচে গেলেন। জার্মানি বা ব্রাজিল হলে হয়তো গোটা তিনেক গোল রোমেরোকে হজম করতে হত।
সব মিলিয়ে মন ভাল করে দেওয়া ম্যাচ। মেসি গোল করেনি তো কী হয়েছে? গোলটা তো সেই ওরই সাজিয়ে দেওয়া। যা আগের দিন প্র্যাক্টিসে দেখেছি। কর্নার থেকে প্লেটে করে সাজিয়ে দিল, ঠিক সময় হেডটা করে ছোঁ মেরে গোল তুলে নিল অতামেন্দি। সাবেইয়াকে দেখলাম মন খুলে হাসতে। এই মেসিই তো তাঁর ট্রাম্পকার্ড। বার্সার মেসি। যে বারবার বিশ্ব ফুটবলকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে।
গ্যালারির ছবি শঙ্কর নাগ দাসের। |
সেরা পাঁচ মেসি-ম্যাজিক |
১৮ মিনিট: |
সেন্টার লাইনের একটু উপর থেকে মেসির অবিশ্বাস্য স্কিলে একে একে কেটে গেলেন ভেনেজুয়েলার পাঁচ জন। তবে ফাইনাল পাস বাড়িয়েও লাভ হল না। |
৩১ মিনিট: |
বক্সের মধ্যে স্কিলের ফুলঝুরি। তিন জনকে কাটিয়ে শট নিলেন কিন্তু সোজা গেল বিপক্ষ গোলকিপারের হাতে। |
৬২ মিনিট: |
বক্সের ৩০ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের অসাধারণ ফ্রি কিক। ভেনেজুয়েলা ডিফেন্সকে পুরো দাঁড় করিয়ে অল্পের জন্য গোলে না ঢুকে আছড়ে পড়ল সাইড নেটে। |
৬৭ মিনিট: |
প্রথম পোস্ট টার্গেট করে ভাসিয়ে দেওয়া নিখুঁত কর্নার। ওতামেন্দিকে হেড ছাড়া কিছু করতে হয়নি। তবে সোজাসুজি নয়, বল ড্রপ করে গোলে ঢুকল প্রথম পোস্ট দিয়ে। |
৭৭ মিনিট: |
সেন্টার লাইন থেকে প্রথমে সোলো রান। তার পর সতীর্থের সঙ্গে ওয়াল খেলে বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়া। প্রায় জিরো ডিগ্রি অ্যাঙ্গল থেকে মেসির শট কোনও রকমে কর্নার করে বাঁচালেন গোলকিপার। |
|