মিলিনা সান্তানা রামিয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দেশের কারও হয়েই শুক্রবার খেলেননি।
কিন্তু শহরের ফুটবল সম্পর্কিত চিরকালীন উন্মাদনার রেকর্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত থেকে গেলেন। মিলিনা ভারতে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত। বৃহস্পতিবার কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে যিনি আবিষ্কার করেন, ম্যাচের সম্মানীয় আমন্ত্রিত অতিথি এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবে যে প্রোটোকল তাঁর প্রাপ্য, সেটা আদৌ রক্ষিত হয়নি। প্রশাসন পাইলট গাড়ি পাঠিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে হোটেলে নিয়ে যাবে যে গাড়ি সেটাই এসে পৌঁছয়নি! রাষ্ট্রদূতের পাইলট গাড়িতে বসার প্রশ্ন নেই। অগত্যা রাজপথে নেমে জনগণের হলুদ ট্যাক্সি ধরতে বাধ্য হন তিনি। সাড়ে চারশো টাকা গচ্চা দিয়ে বাইপাস সংলগ্ন টিম হোটেলে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত পৌঁছন এই বিরল কম্বিনেশনে। সামনে ট্যাক্সিতে তিনি আরোহী। পিছনে তাঁর জন্য পাইলট গাড়ি।
এর আগে কম করে পাঁচ বার কলকাতা এসেছেন মিলিনা। মিষ্টি দই কোন দোকান থেকে নিয়ে যেতে হয় সেটা অবধি জানেন। অথচ এমন উপেক্ষা কখনও পাননি। হোটেলে পৌঁছনোর পর ভেনেজুয়েলা ফুটবলাররা তাঁর অভিজ্ঞতা শুনে অবশ্য একটুও বিস্মিত হননি। তাঁরা কখনও এই শহর মাড়াননি তো কী, রাষ্ট্রদূতকে ঝটিতি ব্যাখ্যা করে দেন গোটা ব্যাপারটা ম্যাডাম, মেসি মেসি। এই শহর ওকে নিয়ে এখন এমন উন্মত্ত যে কোনও কিছুই আর স্বাভাবিক ভাবে চলছে না।
মিলিনা এ বার আর ক্ষুব্ধ নন। বরঞ্চ আতঙ্কিত। বলছেন, “এয়ারপোর্ট থেকে আসতে আসতে তাই দেখলাম। খালি আর্জেন্তিনার পতাকা আর মেসির ছবি। বাবা তোমরা ভাল খেলবে কী করে? মনে রেখো, আমাদের দেশের কাছে কিন্তু এই ম্যাচের অসম্ভব গুরুত্ব।”
টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁকে দ্রুত আশ্বস্ত করে, কিছু চিন্তা করবেন না। ‘ক্যালকুটা’র লোক সমর্থন করছে মেসিকে। আর্জেন্তিনাকে নয়। গ্যারান্টি দিচ্ছি, এরা মেসির বাইরে একটা প্লেয়ারের নাম বলতে পারবে না। আর মাঠে মেসিকে তাঁরাই দেখছে। মিলিনা এমন একটা প্রত্যয় নিয়ে বিশ্রাম নিতে যান যে মেসিকে আটকে দিলেই কলকাতার সব সমর্থন শেষ। তার পর ভেনেজুয়েলা। মাঠে এবং গ্যালারিতে শুধুই ভেনেজুয়েলা। |
ম্যাচের একমাত্র গোলকারী ওতামেন্দিকে যখন প্রবল উচ্ছ্বাসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন লিওনেল মেসি, তখন মনে হচ্ছিল মিলিনা না হয় নন-টেকনিক্যাল মানুষ। ভেনেজুয়েলা ম্যানেজমেন্ট মেসিকে রোখা নিয়ে এত নিশ্চিন্ত ছিল কেন? নিজেদের নৈপুণ্যের ওপর আস্থা? নাকি স্বচ্ছন্দ অনুমান, দেশের হয়ে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে উজাড় করে খেলবেন না ফুটবলের রাজপুত্র?
মেসি সম্পর্কে ফুটবলের রাজদরবারে বরাবরই বলা হয়েছে তিনি এক এবং অভিন্ন নন। দুইয়ে বিভক্ত। মেসি ওয়ান যিনি দেশের হয়ে খেলতে নামেন। ভাল খেলেন। জাত চেনান। কিন্তু হিরে-জহরত হয়ে ওঠেন না। মেসি টু যিনি বার্সেলোনায় একা ম্যাচ জেতান। বিশ্বের সব ডিফেন্স উড়িয়ে দেন।
অবশ্য মেসি একা নন। অন্য খেলার আধুনিক ক্রীড়াবিদদের সম্পর্কেও একই অভিযোগ। তাঁদের প্রত্যেকের দুটো সত্তা। একটা যখন দেশের হয়ে খেলেন। একটা যখন বণিকের হয়ে অর্থ উপার্জনের পারফরম্যান্সে নামে। বলা হয় পরিবর্তিত পৃথিবীতে আধুনিক ফুটবলার দুটো টুর্নামেন্টে দেশের জন্য ঝুঁকিটুকি নেয়। তা-ও বাধ্য হয়ে। কোপা আমেরিকা/ইউরো কাপ। এবং বিশ্বকাপ।
ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি যতই ফিফার রেকর্ড বইতে যাক, মেসির তাতে কী? বরঞ্চ দেশের হয়ে এখানে ঠ্যাং ভাঙলে বার্সেলোনা মালিককে কৈফিয়ত দিতে হবে। ফুটবলের মতো আর সব খেলাতেই যে একই ট্রেন্ড। ক্লাব আগে, দেশ পরে। রামনাথন কৃষ্ণন মাত্র হপ্তাখানেক আগে বলছিলেন, তাঁর কাছে ডাবলসে ভারতের সর্বোচ্চ কৃতিত্ব কৃষ্ণন-জয়দীপ জুটির অস্ট্রেলিয়া চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে ম্যাচ জেতা। সে কী? লি-হেশের এতগুলো গ্র্যান্ডস্লাম ডাবলস খেতাব? কৃষ্ণন বিনম্র ভাবে মনে করিয়ে দেবেন, চ্যালেঞ্জ রাউন্ডের সেই গোটা বছরে অস্ট্রেলীয় জুড়ি নিউকোম্ব-রোচ কোনও ম্যাচ হারেনি। আর সিঙ্গলসেও প্রথম পাঁচে ছিলেন। “এখন তো পেশাদার যুগে বড় প্লেয়াররা ডাবলসই খেলে না। ডেভিস কাপ তো আরওই তাদের কাছে ডাইনোসর।” কৃষ্ণনের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল সল্টলেকে অন্য খেলারও ব্যাকরণ হতে যাচ্ছে।
আবার বলা যাক, ভারতে ফুটবলের সবচেয়ে মায়াবি রাত শুক্রবার তৈরি হতে পারে এই আন্দাজ পেশাদারি ঠিকুজিকুষ্ঠি মেনে একেবারেই ছিল না। কেউ ভাবেনওনি, এত দিনের চলা প্যাটার্নকে মেসি তাচ্ছিল্য করতে পারেন। হ্যাঁ, এটুকু বোঝা যাচ্ছিল, ফিফা ফেয়ার প্লে দিবসটাকে সাংগঠনিক নানান বিশৃঙ্খলার মতোই হাস্যকর দেখাবে। প্রেমে এবং যুদ্ধে যেমন অন্যায় বলে কিছু নেই, তেমনি মেসিদের জন্যও ফেয়ার প্লে দিবস বলে কিছু হয় না। বিপক্ষ তাঁকে চোরাগোপ্তা মারবেই। মেরে যাবে। মেরে আজকের মতো গোললাইনে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে দেবে। তিনি মেসি বিয়র্ন বর্গোচিত মেজাজে তবু থেকে যাবেন ভাবলেশহীন। রাতে খেলা শেষ হওয়ার পর মাঠে ঢুকে দেখলাম, আর্জেন্তিনা শিবিরকেই মনে হচ্ছে যেন ০-১ হেরেছে। কঠিন ম্যাচ জিতে ফূর্তির যে ফুরফুরে ব্যাপার থাকে সেটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য। মেসি যন্ত্রণায় হাঁটু মুড়ে দাঁড়ানো। এত ক্লান্ত এবং বিক্ষত, যেন দাঁড়ানোর সব শক্তি শুষে নিয়েছে কেউ। তাঁকে এবং তাঁর দলকে ঘিরে ভিড় করা পুলিশকর্মী-জংলা পোশাকধারী টাস্ক ফোর্স। ভিড়ে শুনলাম প্রবল আলোচনা হচ্ছে, বেচারি একে এত মারে, যে কোনও দিন ঠিক জিদান হয়ে যাবে। পাল্টা ঢুঁসো মারবে। অন্য জন তর্ক জুড়ে দিলেন, কোনও দিন হবে না। তখন কে বলবে, এদের কাজ মেসিদের সামলানো।
আলোচনার কারণ অবশ্য হাতে ধরা মোবাইল ক্যামেরায় কিছুতেই মেসির ছবি ক্লিক করতে না পারা। তিনি তখন হাঁটুতে হাত দিয়ে এমন যন্ত্রণায় কাতর যে মুখটা ভেতরে গোঁজা, ছবি ভাল আসবে না। দেখে মনে পড়ে গেল ভারতীয় ক্রিকেট ড্রেসিংরুমে চালু রসিকতা। ওরে পুলিশের মোবাইলে সচিনের যত ছবি আছে ক্রিকেট ফটোগ্রাফারদের কাছেও নেই।
এবং ভারতীয় ক্রিকেট মাঠ সচিনের জন্য যে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা সরবরাহ করে থাকে, সল্টলেক তা-ই যেন উপুড় করে দিল আর্জেন্তেনীয় দশ নম্বরের জন্য। মেসি প্রথম দশ মিনিটে এমন তিনটে মুভ করলেন যার এক-একটা ফুটবল চিত্রকলা। ফুটবলের সিমা আর্ট গ্যালারিতে সাজিয়ে রাখার মতো। কলকাতা দর্শকও যেন দ্রুত বুঝে গেল, দেশ নয়। মেসি ওয়ান নয়। আজ একটাই লোক। যিনি আর্জেন্তিনার অধিনায়কত্ব করছেন, বার্সেলোনা এবং আর্জেন্তিনা দুটো ব্লাড গ্রুপই তাঁর মধ্যে মিশে গিয়েছে। দ্রুত চিৎকার শুরু হল, মেসি-মেসি-মেসি। যা দেখলে সচিনের হয়তো মনে হত, ভাগ্যিস এক দিনের জন্যই জায়গির ভাগাভাগি হল। বেঙ্গালুরু থেকে মেসি ম্যাচ কভার করতে আসা বিখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক যা দেখে বলছিলেন, “এটা কি অনেকটা সৌরভ আর ধোনির মতো হল? এক জন তৈরি করল, অন্য জন ফসল তুলল?” ভদ্রলোকের কলকাতায় নেমে গবেষণা বলছে, মেসি আজ সচিনোচিত প্রশংসা পাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু কলকাতায় আর্জেন্তেনীয় সমর্থনের উপনিবেশ তৈরি করে গিয়েছেন দিয়েগো মারাদোনা। মেসি তাঁর উত্তরাধিকার মাত্র। সল্টলেক জনতার অবশ্য মনে হল না, অন্তত আজকের জন্য মারাদোনাকে আদৌ মনে পড়ছে বলে। তাঁরা মেসি-সিক্ত এবং সিক্তই থাকতে চান।
পেলে খেলা ছাড়ার পর বলেছিলেন, ফিল্মে পরবর্তী কালে নিজের খেলা দেখে তিনি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছেন। বিস্ময়ের কারণ তাঁর কম্পিউটারাইজড্ ব্রেন যা ম্যাচের সব রকম ঘূর্ণি পরিস্থিতিতেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার গতিটা তিনি নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারেননি। খেলা ছাড়ার পর মেসিও হয়তো পারবেন না। কিন্তু এখনকার মতো তাঁর শিল্পকলায় কলকাতা ফুটবলমহল বিহ্বল। গৌতম সরকার যিনি ট্যাকলার হিসেবে ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, যিনি চিরকাল বিদেশি ফুটবলার এলে অন্তত অনুমানের চেষ্টা করেছেন কোথায় ট্যাকল করা যেত, যিনি ইডেনে পেলেকে পর্যন্ত সফল হার্ড ট্যাকল করে দেখিয়েছিলেন, তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললেন, “দৈবিক প্রতিভা। কিছু করার নেই।”
মেসির ব্যক্তিগত মন ভরানোর চেয়ে আর্জেন্তিনার কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ যদিও নতুন জমানার আবির্ভাবেই প্রথম ম্যাচ জয়। ১৯৮৬-তে মারাদোনার আর্জেন্তিনা যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল, আনন্দবাজার খেলার দফতরে তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল দু’বছর আগের একটা ছবি সংগ্রহের জন্য। কী ছবি, না ’৮৪-র নেহরু কাপে কোচ বিলার্দোকে মাঠ থেকে বার করে দিয়েছেন রেফারি। কে বলতে পারে, ২০১৪-য় রিও-র ফাইনালের পর আনন্দবাজার স্পোর্টস আগ্রহী হয়ে তিন বছর আগের সল্টলেকের একটা ছবি খুঁজবে নাম্যাচ জেতার পর মেসি জড়িয়ে ধরেছেন সতীর্থদের। কারণ তখনও তো ছিয়াশির মতোই বলতে হবে, বিশ্বজয়ের অভিযান দিবস কলকাতা থেকেই শুরু হয়েছিল।
আর ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত? তিনি কি দলকে গভীর অভিশম্পাত দিচ্ছেন, যারা বলেছিল মেসিকে আটকে দেবে? রাতে যোগাযোগ করা হলে মিলিনা বললেন, “একটুও নয়। ভেনেজুয়েলা কলকাতা দর্শকের কাছে একটা নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এল। ওরা ব্রাজিলকে চিনত। আর্জেন্তিনাকে চিনত। আজ থেকে ভেনেজুয়েলার পরাক্রমের কথাও জানল।” কিন্তু মেসির কাছে হেরে যাওয়া? রাষ্ট্রদূত বললেন, “আগে টিভিতে দেখে বুঝিনি। আজ মাঠে বসে দেখলাম। ও অতিমানব। মেসির কাছে হারায় লজ্জা নেই।” |