অ্যাকাডেমির আদলে কিছু হোক |
সবুজ ফিরিয়ে ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ পার্ক গড়ে তোলার আর্জি জানাচ্ছেন এক জন। আর এক জন
শিলিগুড়িতে কী ভাবে চাঁপা, টগর, শিউলি, গন্ধরাজের ঘ্রাণ ফেরানো যেতে পারে সেই দিকনির্দেশ দিয়েছেন।
অন্য আর এক জন স্বপ্ন দেখছেন, কলকাতার নন্দন চত্বরের মতো এলাকা জুড়ে সাংস্কৃতিক
কর্মকাণ্ডের। কলম ধরলেন শহরের ৩ কন্যা। পারমিতা দাশগুপ্ত |
ছোটবেলার শুরুটা কেটেছে দার্জিলিঙে। ছোট থাকতেই বাবা-মায়ের হাত ধরে পাহাড় ছেড়ে সমতল শিলিগুড়িতে। প্রথম দিকে কিছুটা ভারাক্রান্ত হলেও ধীরে ধীরে শিলিগুড়ি আমাকে আপন করে নিয়েছেন। শহরটা এখন আমারও ভীষণ প্রিয়। আর প্রিয় বলেই আমার শিলিগুড়ির সৌন্দর্যে ঘাটতি দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে জন্য সোজাসুজি কিছু বিষয় তুলে ধরা জরুরি। এটা জানি, যে শিলিগুড়িতে শতবর্ষ আগে জনসংখ্যা ছিল ১০ হাজারের আশেপাশে। সেখানে এখন জনসংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। শিলিগুড়ি শহর কিংবা মহকুমার আয়তন কিন্তু বাড়েনি। অথচ বেড়ে চলেছে জনসংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। বহুতল। হারিয়ে গিয়েছে কাঠের বাড়ি। শহর ও লাগোয়া এলাকায় জলাশয় খুঁজে পাওয়া ভার। এদিক-ওদিক যে দু-চারটি জলাশয় রয়েছে তাও চুপিসাড়ে কে বা কারা বুজিয়ে বহুতল তুলতে তৎপর কে জানে! গাছও কমছে। আচ্ছা সেবক রোড চওড়া করার সময়ে গণ ভোট নিয়ে প্রচুর গাছ কাটা হয়েছিল। সে সময় প্রচুর গাছও বোনা হয়েছিল বলে শুনেছি। তা কোথায় গেল? বিশ্ব পরিবেশ দিবস বা অন্য অনেক সময়ই কত ঘটা করে গাছ লাগানো হয়। কিন্তু আদৌ কী সব সংরক্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয়তা অবলম্বন করা হয়? উত্তর মেলে না। মনে রাখা দরকার, চারা বুনলেই শুধু হল না, তা বাঁচানোও সকলের দায়িত্ব। একটু বেশি ভূমিকা অবশ্যই পুরসভা-প্রশাসনের। মহানন্দার আশেপাশে দাঁড়ানো যায় না। আজ পর্যন্ত মহানন্দার তীরের সৌন্দর্যায়ন করা গেল না? আমাদের শহরে এত উদ্যোগের কথা শুনি। তা হলে এ কাজটা হয় না কেন সেটাই বুঝে উঠতে পারি না। আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন মূল শহরে খালি জমি বলতে কিছুই নেই। সেই অর্থে পাড়া বা পাড়ার লোকেরা বলতে যা বোঝাত, তা কিন্তু আজ অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। কারণ, হয়ত সারা শহরটা জুড়েই মাখা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে বহুতল ফ্ল্যাট বাড়িগুলো। পাকা, চওড়া এবং হাইড্রেনে রাস্তাগুলোর আমূল পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও শহরটা পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে না। বড্ড আগোছালো। কর্মসূত্রে বাইপাসের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা হওয়ায় ওই রাস্তাটায় এক দশকের বেশি সময় ধরে যাতায়াত করতে হচ্ছে। যখন বাইপাস তৈরি হল, তখন প্রচুর গাছ লাগানো হয়। কিন্তু পুরো বাইপাস জুড়ে সেই অর্থে দু’পাশে কিন্তু গাছের সংখ্যা প্রায় নেই। সকালে স্কুলবাসে যেতে যেতে দেখি, আর ভাবি নেই কোনও খোলা মাঠ, যেখানে ছোটরা মু্ক্ত আকাশের তলায় খেলতে পারে। রাস্তার দু’ধারে শুধু বড় বড় পাকা বাড়ি আর দোকানপাট। সবুজ কোথায় গেল? আর হল সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক চর্চা। ওই জগতের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে টের পাই ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক চর্চা। পুরো শহরটা জুড়েই রয়েছে প্রচুর প্রতিভা। একদল মানুষ কিন্তু নিরন্তর বিভিন্ন আঙ্গিকে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকে। আর তাতেই শহর শিলিগুড়ি বাণিজ্যিক শহর হিসেবে আখ্যা পেলেও এখানে কিন্তু রয়েছে এক সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। আর সবচেয়ে ভালো লাগে ভাবতে যে গত দশ বছরে এই শিল্প চর্চা অনেক ক্ষেত্রেই পেশাদারিত্ব লাভ করেছে। তাই স্বপ্ন দেখি এখানেই কি তৈরি হবে টালিগঞ্জের মতো স্টুডিওপাড়া। যেখানে ভবিষ্যতের নবীন প্রজন্ম প্রতিভা বিকাশ করতে পারবে এবং উপার্জনের আর একটা পথ খুলে যাবে। শপিং মল, আইনক্স গড়া হচ্ছে তা ভাল কথা। কেন কলকাতার নন্দন চত্বরের মতো এখানে কোনও প্রাঙ্গণ তৈরির উদ্যোগ নেই। হতেও তো পারত সেই বৃহৎ জায়গায় একটি আর্ট কলেজ কিংবা কবিতা-নাটক, নাচ-গানের অ্যাকাডেমি। যাঁরা প্রশাসনে আছেন, একটু ভাবুন। শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকায় খোলামেলা জায়গা এখনও তো কম নেই। নানা আলোচনার সময়ে কেউ বলেন, এতদিন হয়নি তো কী হয়েছে! এবার হবে। ‘হচ্ছে-হবে’ শুনতে শুনতে মহানন্দা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। আরও না-হয় অপেক্ষা করব। সকলে মিলে জোরাল আওয়াজ তুলব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস একদিন সবুজ হবেই আমাদের শিলিগুড়ি। একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবায়। যেমন শহরের উপকণ্ঠে দুটি বড় মাপের বেসরকারি বিনোদন পার্ক হয়েছে। সেখানকার প্রবেশ মূল্য সকলের ধরাছোঁয়ার মধ্যে নয়। ভেতরে ঢুকলে সাধারণ খাবারের যে দাম নেওয়া হয় তা অকল্পনীয়। তখনই মনে হয়, যা কিছু উন্নয়ন তার সুফল কী শুধুই বিশেষ একটি শ্রেণির জন্য অলিখিত ভাবে সংরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে? মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রেণির পরিবারের ছোটদের বিনোদনের জন্য কোনও ব্যবস্থা করা হবে না কেন? যে কোনও কিছু গড়ার আগে সকলের কথাই ভাবা হোক। |