বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের মান যে বেহাল, তা স্বীকার করছেন উপাচার্য নিজেই। বিভাগীয় ডিন স্বীকার করছেন, স্নাতক স্তরে নিয়মিত ক্লাস নিতে চান না শিক্ষকরা। আর তার জেরেই অবহেলিত হচ্ছে স্নাতক স্তরের পঠনপাঠন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। আর পরিস্থিতি জেনেবুঝেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ।
কোনও মফস্সল-গঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয় নয়। খাস কলকাতার বুকেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব ছবি এমনটাই। আর তার সমস্যাটা এতই গভীরে যে, এ বছর রবীন্দ্রভারতীতে স্নাতক স্তরে ৭০০টি আসনের মধ্যে ৩১৮টি, অর্থাৎ ৪৫ শতাংশই ফাঁকা থেকে গিয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, সংস্কৃত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস সব বিভাগেই কম-বেশি একই অবস্থা। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে অর্থনীতি বিভাগ। সরাসরি ভর্তির সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও ওই বিভাগ এক জন ছাত্রও পায়নি।
উচ্চ মাধ্যমিকের পরে কলেজে-কলেজে যেখানে ভর্তির জন্য হুড়োহুড়ি, সেখানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন এড়িয়ে যাচ্ছেন পড়ুয়ারা?
মূলত মানের অবনমনই যে ছাত্রদের বিমুখ করেছে এবং রবীন্দ্রভারতীতে এই পরিস্থিতি যে রাতারাতি হয়নি, তা মানছেন শিক্ষকদের অনেকেও। কারণ হিসেবে তাঁরা শিক্ষকদের একাংশের চরম গাফিলতিকেই দায়ী করেছেন। পাশাপাশি, তা রোখার জন্য শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও যে তৎপর হননি, তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কলা বিভাগের ডিন সনৎ ঘোষ বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের পঠনপাঠন বেশ কয়েক বছর ধরেই অবহেলিত। অনেক সময়েই বিভিন্ন বিভাগের স্থায়ী শিক্ষকেরা স্নাতকোত্তরে ক্লাস নিলেও স্নাতক স্তরের ক্লাসে যেতে চান না বলে অভিযোগ পাই। অনেক অনুরোধেও ফল হয়নি।” বিভাগীয় প্রধানদের প্রায় সকলেরই অভিযোগ, সকালের দিকে ক্লাস থাকলে অনেক শিক্ষকই আসেন না। ফলে পড়ুয়ারাও ক্লাসমুখো হন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৬০। তাঁদের অনেকেই বেলা দু’টোর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন না এবং দরখাস্ত না দিয়ে দিনের পর দিন ছুটিতে থাকেন বলে শিক্ষকদের একাংশেরই অভিযোগ। এ ছাড়া, অস্থায়ী শিক্ষকেরা কেমন পড়াচ্ছেন বা কী ভাবে পঠনপাঠনের মান আরও ভাল হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয় না বলে জানিয়েছেন তাঁরাই।
এ ব্যাপারে উপাচার্য করুণাসিন্ধু দাসের প্রতিক্রিয়া, “কয়েক জন স্নাতক স্তরের ক্লাস নিতে চান না, এটা ঠিক। এ জন্য শিক্ষকরাই দায়ী। দায়িত্বটা ওঁদেরই বুঝতে হবে।” কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? এ ব্যাপারে নিজের দায় কার্যত এড়িয়ে গিয়ে উপাচার্য বলেন, “এ রকম কিছু এলোমেলো লোক সব জায়গাতেই থাকেন। কী আর ব্যবস্থা নেব?”
রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে, অর্থাৎ ১৯৬১ সালে চারুকলা ও দৃশ্যকলা চর্চার কথা ভেবে রবীন্দ্রভারতীর পরিকল্পনা করা হয়। পরের বছর ওই উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু অচিরেই সেখানে চালু হয় কলা বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে তার গুরুত্বই প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু তাতে যে সুফল মেলেনি, এ রাজ্যের পড়ুয়াদের রবীন্দ্রভারতীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তারই প্রমাণ।
রবীন্দ্রভারতীর এই পরিস্থিতির কথা শুনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির যে এমন হাল, তা নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বুঝতে পারছে। পঠনপাঠনের মান ও উৎকর্ষ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আইন সংশোধন ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে রাজ্য সরকার।”
রবীন্দ্রভারতীর স্নাতক স্তরে কয়েক বছর ধরেই ভর্তি নিয়ে সমস্যা ছিল। যদিও কলকাতার বহু কলেজের তুলনায় ভর্তির শর্ত এখানে অনেক সহজ। তবু বার কয়েক নামের তালিকা ঝুলিয়েও সব আসনে ছাত্রভর্তি হচ্ছিল না। পরে, মূলত ছাত্র সংসদের তৎপরতায় ক্লাস ভরে যেত, এমনকী উপচে পড়ত।
এতে যে পঠনপাঠনের মান আরও নিম্নগামী হচ্ছে, তা বুঝতে পেরে এ বার কম ছাত্রছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলা বিভাগের ডিন সনৎবাবু বলেন, “ঠিক হয়, এ বার কোনও বিষয়েই ১০০ জনের বেশি পড়ুয়া ভর্তি করা হবে না। আর ভর্তি নেওয়া হবে কেবল মেধাতালিকার ভিত্তিতে। তাতে সব আসন না ভরলেও সিদ্ধান্ত বদলানো হবে না।” কিন্তু আসন সংখ্যা কমিয়েও যে ৪৫ শতাংশ আসন ফাঁকা থেকে যাবে, শিক্ষকেরা তা আন্দাজ করতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, এ বার অর্থনীতিতে ভর্তির জন্য মাত্র ১৬টি আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্যে মাত্র দু’জন কাউন্সেলিংয়ে আসেন। তবে তাঁরাও ভর্তি হননি। এর কারণ কি মানের অবনমন? বিভাগীয় প্রধান বিন্দি শ তা মানেন না। তাঁর মতে, “অর্থনীতি পড়ার ঝোঁক এখন সব জায়গাতেই কম।” ইতিহাসে ৩৫টি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনে ৪৪টি করে, ইংরেজিতে ২৫টি, বাংলায় ৩২টি, সংস্কৃত-র ৩৮টি আসন ফাঁকা থেকে গিয়েছে।
পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ছাত্র সংসদ (এখন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দখলে) ফাঁকা আসনে ঢালাও ভর্তির দাবি তুলেছে। মানের আরও অবনমন হওয়ার আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি নন। ছাত্রদের চাপের মুখে তাঁদের কী করণীয়, তা জানতে চেয়ে উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান সুগত মারজিৎকে চিঠি দেন উপাচার্য। জবাবে সুগতবাবু জানান, চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে অ্যাডমিশন বোর্ড ও কলা বিভাগের শিক্ষক সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রভর্তি হবে। তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্র সংগঠনের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন বিরোধিতা না করেন।” |