দৃষ্টিহীনদের জন্য সে অভিনব দাঁড়িপাল্লা তৈরির নকশা বানিয়েছে। আঁধার তার বাড়িতেই।
ওই যন্ত্র তৈরি করে সে দৃষ্টিহীনদের স্বনির্ভর করার স্বপ্ন দেখে। বাড়িতে তার চরম অনটন।
অর্থের অভাবে বিজ্ঞানের বদলে কলা নিয়ে পড়তে হয়েছে। কিন্তু উদ্ভাবনের নেশা তার কমেনি।
স্রেফ ওই নেশা এবং অবশ্যই অধ্যবসায়ের জোরে ওই দাঁড়িপাল্লার নকশা তৈরি করে রাহিয়া খাতুন জিতে নিয়েছে এ রাজ্যের সেরার শিরোপা। বোলপুরের মহিদাপুর গ্রামের মির্জাপাড়ায় খড়ের চালার এক কামরার মাটির বাড়ি। বিপিএল কার্ড নেই। জোটেনি ইন্দিরা আবাস যোজনায় মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। অভাবে দুই দিদি স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। দু’বেলা ঠিকমতো খাবারও জোটে না আট জনের সংসারে। এমনই পরিবারের মেয়ে রাহিয়া ‘ন্যাশনাল লেভেল এগ্জিবিশন অ্যান্ড প্রোজেক্ট কম্পিটিশন, ২০১১’-য় পেয়েছে সেরার পুরস্কার। সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে সে পুরস্কার নিয়ে এসেছে। |
ছয় ভাইবোনের মধ্যে সে সেজো। বাবা শেখ মকবুল ও মা নাপেসা বিবি অক্ষর জ্ঞানহীন। মকবুলের দিনমজুরির সামান্য আয়ে সংসার চলে। বাড়িতে ছিটেবেড়ার মাচার উপর ছোট্ট কুঠুরি। মই বেয়ে সেখানে উঠে রাহিয়া ও তার তিন ভাই-বোন পড়াশোনা করে। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। পাশের দাদার বাড়ি থেকে বিদ্যুতের তার টেনে এনে ছেলে-মেয়েদের পড়ার জন্য ওই কুঠুরিতে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছেন মকবুল।
তাঁর কথায়, “রাহিয়ার দুই দিদিকে আর পড়াতে পারিনি। এখন মাঝে মধ্যে ওরাও মাঠে খাটতে যায়। তবে ছোট থেকেই রাহিয়া পড়াশোনায় খুব ভাল। তাই, ওর পড়াশোনা বন্ধ করিনি। লোকের কাছ থেকে বই-খাতা চেয়ে আনি।” কিন্তু তাতে মনের কৌতূহল আর আবিষ্কারের নেশায় এতটুকুও চিড় ধরেনি। বরং দৃষ্টিহীনদের রোজগারের পথ দেখাতে সে তৈরি করে ফেলেছে এক ধরনের দাঁড়িপাল্লা।
কেমন সে যন্ত্র? বর্তমানে বোলপুরের শ্রীনন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি হাতে সেই দাঁড়িপাল্লার মডেল নিয়ে বলছিল, এই যন্ত্রের কাঁটার কাছে পারদ ভর্তি একটি ছোট ‘ইউ’ আকারের পাইপ থাকবে। তার চারটি জায়গায় বিদ্যুতের তার লাগানো হবে। ওই তারের মধ্যে বিদ্যুৎ চালনার জন্য ব্যাটারি থাকবে। দাঁড়িপাল্লার এক দিকে নির্দিষ্ট বাটখাড়া দিয়ে অন্য দিকে মাল দিতে হবে। ওজনে মাল কম হলেই এক রকমের শব্দ হবে। মালের পরিমাণ বেশি হলে অন্য শব্দ হবে। আবার পরিমাণ ঠিক হলে, আলাদা শব্দ। রাহিয়ার দাবি, “শব্দ শুনেই দৃষ্টিহীনেরা মাল ওজন করতে পারবেন। এই দাঁড়িপাল্লা দিয়ে তাঁরা মাল বিক্রি করে স্বনির্ভর হতে পারবেন। কেউ ঠকাতে পারবেন না।”
মহিদাপুর হাইমাদ্রাসায় দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাহিয়া এই ‘প্রজেক্ট’ তৈরি করেছিল। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শেখ কামরূপজামান বলেন, “রাহিয়ার কীর্তি আমাদের জেলাকে গর্বিত করেছে। ওর মেধা ও ইচ্ছা শক্তির কাছে দারিদ্র হার মেনেছে।” আর রাহিয়ার আক্ষেপ, “বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু টাকার অভাবে কলা বিভাগে ভর্তি হয়েছি। তবে সুযোগ পেলে পরে মানুষের উপকারে লাগে, এমন নানা যন্ত্র আবিষ্কার করতে চাই।”
রাহিয়ার মতোই কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীন নেওয়া ওই প্রতিযোগিতায় পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সেরা হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের বারবেন্দ্যা গ্রামের বাসিন্দা, বারবেন্দ্যা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্র বিপ্লব শীটও। রাস্তায় অতিরিক্ত মালবাহী গাড়িকে শনাক্ত করার উপায় বার করেছে সে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বিপ্লবের মাথায় এসেছিল অপ্রচলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধাতব বাম্পারের সাহায্যে অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ি শনাক্তকরণের পদ্ধতি। সম্প্রতি দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের হাত থেকে পাওয়া পুরস্কার তার সেই কৃতিত্বকেই স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিপ্লবের বাবা কৃষিজীবী মহাদেববাবু ও সুলেখাদেবী বললেন, “ছোট থেকেই বিজ্ঞান ওর প্রিয়। কিন্তু এত বড় সাফল্য পাবে ভাবিনি!” |