|
|
|
|
শিকড়ের টানে ও-পারের গ্রামে এ-পারের ডাক্তারবাবু |
বিপ্লবকুমার ঘোষ • দেবহাটা সীমান্ত |
ইছামতীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে নদীর দু’পাড়ে। এক পারে হাসনাবাদ, অন্য পারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার দেবহাটা গ্রাম। বহু দিন সংস্কার না হওয়া ভাঙা প্রাইমারি স্কুলে মানুষের ঢল। বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন তাঁরা। কেউ কেউ রাত থেকেই রয়ে গেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে মানুষের ঢল পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে সীমান্তের শেষ সীমানায়। হাতে ফেস্টুন।
যাঁর জন্য এত মানুষের প্রতীক্ষা, তিনি পশ্চিমবাংলার প্রবীণ স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অনুপম দাশগুপ্ত। বছরে দু’বার তিনি পা রাখেন বাংলাদেশের এই অজ গ্রামে। কলকাতায় এত রোগীর ভিড় ছেড়ে বাংলাদেশের ওই অজ গাঁয়ে কেন?
শিকড়ের টানে দেশে তো ফেরেন অনেকেই। ফেরেন নিজের জন্য। কিন্তু চিকিৎসক অনুপম দাশগুপ্ত গ্রামে ফেরেন পরার্থে। “দেশভাগের আগে ওই গ্রামেই আমার শৈশব কেটেছিল। চলে আসার সময় চোখের জল ফেলে শপথ নিয়েছিলাম, কোনও দিন যদি পারি এখানে এসেই মানুষের সেবা করব”, বলছিলেন অনুপমবাবু। ভাঙা স্কুলবাড়ির বাইরে তখনও বহু মানুষের প্রতীক্ষা। বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের।
অনুপমবাবুকে সসম্মানে সীমান্ত পেরিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলেন বিডিআরের এক অফিসার। সীমান্ত পেরোনোর আগেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এখানকার এক অফিসার বলে রেখেছেন, “ডাক্তার সাব, ফিরনেকা দিন মেরে দোস্তকো এক বার দিখানা হ্যায়।” প্রথম দিকে এই পার বা ওই পার, পরিচয়পত্র ও নাগরিকত্ব প্রমাণের কড়াকড়ি থাকলেও এখন আর নেই। ‘ডাক্তারসাব’-এর জন্য এখন দরজা খোলা। গত চব্বিশ বছর ধরে ‘অতিথি’ এই মানুষটি প্রিয় হয়ে উঠেছেন দু’পারেরই রক্ষী বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশ রাইফেলস-এর মহম্মদ হাবিব মণ্ডল নিজেও প্রতীক্ষায় ছিলেন ওই মানুষটির জন্য। বললেন, “ওনাকে দেখাব বলে আমার আম্মাকে স্কুলবাড়িতে বসিয়ে এসেছি।” |
|
রোগী দেখছেন ডাক্তারবাবু। —নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু গ্রামীণ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে এখানে এত মানুষ আসছেন কেন? দেবহাটা গ্রাম উন্নয়ন সভাপতি আসারুল হক বললেন, “গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ডাক্তারের দেখা পাওয়া মুশকিল। বেশির ভাগই শহরে চলে গিয়ে নিজের পসার বাড়ান। অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই ডাক্তার অমিল। ন্যূনতম ওষুধও নেই। মানুষ এখানে ছুটে আসছেন দু’টি কারণে। ডাক্তার দেখানো, সঙ্গে ওষুধ পাওয়া।” কিন্তু তা কী করে সম্ভব? অনুপমবাবু বললেন, “তিন থেকে ছয় মাসের ব্যবধানে বেশ কিছু ওষুধ আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে জমে যায়। তা ছাড়া দু’একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিছু ওষুধপত্র পাঠায়।
সব নিয়ে যাই ওদের জন্য।” এই বিশাল কর্মকাণ্ডের বেশ কিছু কাজ ভাগ করে নিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের কয়েক জন ছাত্র। দেবহাটা গ্রামের এই মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনার সব দায়িত্বই অনুপমবাবুর। তারাই মাথায় করে ওই সব ওষুধের বোঝা নিয়ে যায় গ্রামে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মইদুল ইসলাম, রঞ্জন কর্মকার সারা দিন রোগীদের সেবায় ব্যস্ত। বলে, “ডাক্তারবাবুকে কথা তো দিয়েই রেখেছি। যাতে পাশ করে এসেই এই গ্রামের লোকদের সেবা করতে পারি।”
এই মুহূর্তে ইছামতীর বেপরোয়া ভাঙনে দেবহাটা গ্রামের অনেকটাই বিপন্ন। একশো বছরের পুরনো তিনটি কৃষ্ণমন্দিরের একটি পুরোপুরি নদীগর্ভে চলে গেলেও বাকি দু’টি রক্ষা পেয়েছে ডাক্তারবাবুর চেষ্টায়। প্রসঙ্গ উঠতেই অভিভূত তিনি। বললেন, “এ গ্রামের বেশির ভাগই মুসলিম পরিবার। তাঁদের সহযোগিতায় মন্দির আবার নতুন ভাবে গড়ে উঠেছে। নিয়মিত পুজোও হয়।” মন্দির তৈরির জন্য কেউ এক পয়সা মজুরি নেননি। মন্দির সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন জয়দেব দত্ত। তিনিই বললেন, “পুজো-পার্বণে এখানকার সব মুসলিম পরিবারই অংশ নিয়ে থাকেন।”
ইছামতীর ঘাটে দেখা হল মৈনুদ্দিন মাঝির সঙ্গে। দেবহাটা গ্রামেরই বাসিন্দা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ‘ডাক্তারসাব’-এর বাহন। পারিশ্রমিক না নিয়েই। কেন? ওঁর ‘পোলা’ একবার পাগল হয়ে গিয়েছিল। ওকে ভাল সুস্থ করে তুলেছেন তো ডাক্তারবাবুই। “পয়সা নিমু ক্যামনে?” |
|
|
|
|
|