|
|
|
|
সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া রক্ত কত নিরাপদ, প্রশ্ন |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
রোজ ভোরে সন্তানের কবরের সামনে দঁড়িয়ে শপথ নেন ইদ্রিস আলি। রক্ত-শুদ্ধির শপথ।
সন্দেশখালির দিনমজুর ইদ্রিসের একমাত্র ছেলে মনিরুলের থ্যালাসেমিয়া ছিল। সম্প্রতি সে মারা গিয়েছে। থ্যালাসেমিয়ায় নয়, রক্তের দূষণে। মনিরুলকে প্রতি মাসে রক্ত নিতে হত। আর বার বার রক্ত নিতে গিয়েই এগারো বছরের বালকটি এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হয়, যা শেষ পর্যন্ত তার শমন হয়ে দাঁড়ায়।
মনিরুল দৃষ্টান্ত মাত্র। রক্ত পরীক্ষায় ‘সস্তা’র কিট ব্যবহারের ফলে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে রক্ত-সুরক্ষা (ব্লাড সেফটি) ব্যবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে অভিযোগ। ‘এলাইজা’ কিটের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে হামেশা ‘র্যাপিড’ কিট ব্যবহারের দরুণ বহু ক্ষেত্রে সংগৃহীত রক্তে বিভিন্ন সংক্রমণের হদিস মিলছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফে ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ন্যাকো)-র দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
ইদ্রিসেরও অভিযোগ: সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে তাঁরা নিয়মিত যে রক্ত সংগ্রহ করতেন, যথাযথ পরীক্ষার অভাবে তা থেকেই তাঁর ছেলের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। মনিরুলের চিকিৎসক দেবপ্রিয় মল্লিক বিষয়টি জানিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের। দেবপ্রিয়বাবুর আক্ষেপ, “বহু জায়গায় রক্ত পরীক্ষার ন্যূনতম নিয়ম-কানুন মানা হচ্ছে না। তার মাসুল গুনছেন অসহায় মানুষ। মনিরুল তেমনই এক জন।” |
|
রক্ত নিতে গিয়ে এইচআইভির শিকার হয় মনিরুল। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম থেকে। |
মনিরুলের ঘটনাটি যে বিচ্ছিন্ন নয়, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে জমা পড়া আরও একটি অভিযোগে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। যেখানে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এক শিশুর এইচআইভি সংক্রমণের জন্য সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ককে দায়ী করেছেন তার মা-বাবা। শিশুটি সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং এনআরএসের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিত। বছর ছয়েক আগের ওই ঘটনার তদন্তে নেমে কমিশন সম্প্রতি সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের তদানীন্তন অধিকর্তা আশিস ভৌমিককে ডেকে পাঠিয়েছিল। তাঁর বক্তব্য কী?
আশিসবাবু বলেন, “এ তো বরাবরের সমস্যা! আমাদের পরিকাঠামো দেওয়া না-হলে কাজ হবে কী ভাবে?” অসুবিধে যে হচ্ছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের বর্তমান অধিকর্তা সৌরেন্দ্রনাথ গুছায়েতও। যাঁর বক্তব্য, “এখানে এলাইজা কিট দিয়ে পরীক্ষা হওয়ার কথা। যখন থাকে না, তখন র্যাপিড টেস্ট করি। এই পরীক্ষার সেনসিটিভিটি কম। ডকুমেন্টেশন ঠিক ভাবে করা যায় না। ফলে খানিকটা অসহায়তা তো থাকেই!” উপরন্তু ‘উইন্ডো পিরিয়ডে’ (সংক্রমণ হওয়ার পর থেকে রক্তে তা ধরা পড়ার
মধ্যবর্তী সময়) সংগৃহীত রক্তের বিশুদ্ধতা যাচাই করাও প্রচলিত পরিকাঠামোয় কার্যত অসম্ভব বলে জানিয়েছেন সৌরেন্দ্রবাবু।
শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে যতটা সম্ভব উন্নত প্রযুক্তিতে রক্ত পরীক্ষার কথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক বার বার বলে আসছে। তা সত্ত্বেও এলাইজা কিটের জোগানে সমস্যা কেন?
রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্তারা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে সারা দেশে রক্ত-সুরক্ষার সরঞ্জাম সরবরাহ করে যারা, সেই ন্যাকো-র কর্তারা জানিয়েছেন, মাঝে অল্প ক’দিন এলাইজা কিট অমিল থাকলেও এখন সরবরাহ স্বাভাবিক। ন্যাকো-র অফিসারদের বক্তব্য,
রক্ত পরীক্ষায় কোনও রকম আপস হওয়ার কথা নয়। তবু এমন সব অভিযোগ উঠছে কেন, তা তাঁরা খতিয়ে দেখবেন।
রক্ত পরীক্ষায় এ হেন ‘আপস’ নিয়ে রাজ্যের বিশেষজ্ঞেরাও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ন্যাশনাল এড্স কন্ট্রোল প্রোজেক্ট ৪-এর বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অপূর্ব ঘোষের কথায়, “আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, র্যাপিড টেস্ট যথেষ্ট নিরাপদ নয়। তবু তার সাহায্যে রক্ত পরীক্ষা চালানোটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।”
এবং দুর্ভাগ্যজনক কাণ্ডটি দিনের পর দিন কেন ঘটে চলেছে, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন অপূর্ববাবু। তিনি বলেন, “কিছু দিন আগে এলাইজা কিট অমিল হওয়ায় ন্যাকো বলেছিল সাময়িক ভাবে র্যাপিড কিট ব্যবহার করতে। সেই মতো পশ্চিমবঙ্গের ন’টি রিজিওনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টার মারফত ৫৮টি সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে র্যাপিড কিট সরবরাহ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল, বহু জায়গায় র্যাপিড কিট এত বেশি কিনে ফেলা হয়েছে যে, মাসের পর মাস তা-ই কাজে লাগানো হচ্ছে। মানুষের নিরাপত্তার কথা ভাবা হচ্ছে না।”
রোগীদের প্রাণ নিয়ে এই ‘ছিনিমিনি’ ঠেকাতে রক্ত-সুরক্ষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ইদ্রিস আলি। মানুষকে বোঝাচ্ছেন, রক্ত নেওয়ার আগে তার বিশুদ্ধতা যাচাই করা কতটা জরুরি। সরকারি যে অবহেলার মূল্য চুকিয়ে একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন, অন্য কেউ যাতে তার শিকার না-হন, সে জন্য তিনি নেমেছেন সচেতনতা সৃষ্টির লড়াইয়ে।
সন্তানের কবরকে সাক্ষী রেখে প্রতি ভোরে নতুন করে সেই লড়াইয়েরই অঙ্গীকার করেন ইদ্রিস। |
|
|
|
|
|