|
|
|
|
বিপন্ন সৈকত/১ |
দোরগোড়ায় সমুদ্র, রাত কাটে আতঙ্কে |
সুব্রত গুহ • কাঁথি |
কথায় বলে সমুদ্র যা নেয়, তা ফিরিয়েও দেয়। পূর্ব মেদিনীপুরের সাগর তীরের বাসিন্দাদের জীবনে অবশ্য
এ আপ্তবাক্য ফলেনি। সমুদ্র ভাঙনে এখানকার অনেকেই চিরতরে সর্বস্ব খুইয়েছেন। ভয়াল প্রকৃতি, উদাসীন প্রশাসন
আর রমরমা অবৈধ নির্মাণের ত্র্যহস্পর্শে সঙ্কটে সৈকত পর্যটন কেন্দ্রগুলিও। এই সঙ্কট কেন? আনন্দবাজার-এর অনুসন্ধান। |
‘জলের ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস’।
নেহাতই কথার কথা নয়, পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবাসীর কাছে এ এক ঘোর বাস্তব। জলোচ্ছ্বাস আর আগ্রাসী সমুদ্রের জোড়া কামড়ে রাজ্যের সৈকত পর্যটন কেন্দ্র দিঘা, শঙ্করপুর-সহ কাঁথি উপকূলের বিশাল ভূখণ্ডের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পথে। এক দিকে খামখেয়ালি সমুদ্র, আর অন্য দিকে পরিকাঠামোর অভাব আর সরকারি অবহেলার জাঁতাকলে ইতিমধ্যেই সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের এলাকাভুক্ত ‘দিঘা’ ও ‘ঝাওয়া’ নামে দুটি মৌজা। এ ছাড়াও ‘নীলপুর’ ও ‘বেগুনাডিহি’ নামে আরও দুটি মৌজার দুই-তৃতীয়াংশ সমুদ্রগর্ভে চলে গিয়েছে। সমুদ্র ভাঙনে সর্বস্ব হারানোর আতঙ্কে দিন-রাত কাটাচ্ছেন দিঘা থেকে জলধা পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ কিলোমিটার উপকূলের প্রায় ২৮টি গ্রামের ৭০ থেকে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। |
|
ভাঙনের জের। পুরাতন দিঘায় নিজস্ব চিত্র। |
ভৌগোলিক কারণেই বঙ্গোপসাগরের ঢেউ ক্রমশ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরছে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তথা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। আনন্দদেববাবুর কথায়, “দিঘা সমুদ্রের পশ্চিম দিকে ওড়িশার তালসারিতে সুবর্ণরেখা নদীর মোহনায় বালুচর সৃষ্টি হওয়ায় জোয়ারের সময়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ তাতে ধাক্কা খেয়ে সরে যাচ্ছে পূর্ব দিকে।” আর সুবর্ণরেখা নদীর মোহনায় সৃষ্ট বালুচর ক্রমশ নিউ দিঘায় এসে পড়ছে।
পুরাতন দিঘাকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে ল্যাটেরাইট বোল্ডারের দেওয়াল বানানো হয়েছিল। জোয়ারে জলের শক্তি এতই প্রবল যে অতি মজবুত সেই পাথর ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাথরের নীচ থেকে সরে যাচ্ছে বালি। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ল্যাটেরাইট বোল্ডারের প্রাচীর। পুরাতন দিঘা থেকে আরও পূর্ব দিকে জলধা পর্যন্ত সমুদ্র ভাঙন বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা পুরাতন দিঘার ব্যারিস্টার কলোনির কোল ঘেঁষা পদিমা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের গঙ্গাধরপুর মৌজার। সমুদ্র ভাঙন এখানে এতটাই আগ্রাসী যে ওই মৌজার প্রাচীন বালিয়াড়ি বা প্রাকৃতিক বাঁধ কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। বালিয়াড়ি ভাঙতে-ভাঙতে সমুদ্র ক্রমশ এগিয়ে আসায় গঙ্গাধরপুর মৌজার জনবসতির সঙ্গে সমুদ্রের ব্যবধান এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১২ ফুট দূরত্বে। মূলত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের বাস এই মৌজায়। বালিয়াড়ি বা প্রাকৃতিক বাঁধের ভরসাতেই তাঁরা বাস করছিলেন এত দিন। প্রকৃতির আগ্রাসী রূপ দেখে কপালের ভাঁজ বাড়ছে তাঁদের। পদিমা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান গীতারানি পাত্র উদ্বেগের সুরে বলেন, “একটা বড় ধরনের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ঘটলেই রাতারাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই ৮ থেকে ১২ ফুটের ব্যবধান। দিঘা বা ঝাওয়া মৌজার মতোই সমুদ্রের বিপুল জলরাশির গভীরে তলিয়ে যাবে গোটা গঙ্গাধরপুর মৌজা।” ভাঙনে বিচলিত রামনগর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দেবব্রত দাস বলেন, “গঙ্গাধরপুর মৌজা যদি এক বার সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যায় তা হলে পাশের জগাইবসান, গোবিন্দবসান ও সোমাইবসান মৌজাগুলিতেও বিপদ ঘনিয়ে আসবে। প্লাবিত হতে পারে ওই তিন মৌজার বিস্তীর্ণ অঞ্চলও।” দেবব্রতবাবুর কথায়, “একই অবস্থা তালগাছাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের শঙ্করপুর, চাঁদপুর, জামড়া, তাজপুর, লছিমপুর গ্রামগুলির। সমুদ্র ভাঙন বা সমুদ্রের আগ্রাসনে এই সব মৌজার দেড়শো একরের মতো জমি সমুদ্র গর্ভে ইতিমধ্যেই তলিয়ে গিয়েছে।”
গত কয়েক বছরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভাঙনের জেরে সমুদ্র কম করে ৫০০ থেকে ৭০০ ফুট ভেতরে চলে এসেছে বলে জানালেন জলধার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ জানা, জামড়া-শ্যামপুরের গৃহবধূ গীতা জানা। চাঁদপুরে সমুদ্রের পাড়েই পূর্ণ মাইতির ভুসিমালের দোকান। এক সময় সমুদ্র থেকে কম করে ১৫০ মিটার দূরে তার দোকান থাকলেও ভাঙনে সেই দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১২ ফুটে। আগের মতো তাই আর রাতে দোকানে ঘুমোতে যান না পূর্ণবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘অন্য সময় তেমন ভয় না থাকলেও বর্ষাকালে, বিশেষ করে ষাঁড়াষাঁড়ি বানের সময় সমুদ্র যে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়, তাতে একটা জলোচ্ছ্বাস পলকে গোটা গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
ভাঙন প্রতিরোধে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিক্ততা ঝরে পড়ে পূর্ণবাবুর গলায়। ক্ষুব্ধ পূর্ণবাবু বলেন, “গত দশ-বারো বছর ধরে সেচ দফতর বা দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ ভাঙন প্রতিরোধে কোনও সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেনি। শঙ্করপুর থেকে ১ কিলোমিটার দীর্ঘ যে জিওটিউব বসানো হয়েছিল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু কাঠের বল্লির খাঁচা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। যার ফাঁক দিয়ে সমুদ্রের জোয়ারের জল গ্রামে ঢুকে পড়ছে।” একমত জলধার অনন্ত মণ্ডল, চাঁদপুরের ফণীভূষণ প্রধান, চন্দন সুই থেকে গদাধরপুরের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য ভুবন পাত্র, গোবিন্দবসান গ্রামের মৎস্যজীবী নীলমণি রাউত। তাঁদের বক্তব্য, “পরিস্থিতি আগে যেমন ছিল এখনও তাই আছে। মাঝখান থেকে সরকারের কিছু টাকা জলে গেল।”
কিন্তু এত দিনেও ভাঙন সমস্যার স্থায়ী কোনও সমাধান হল না কেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রশাসনের গা-ছাড়া মনোভাবের পাশাপাশিই সামনে এল দুর্নীতি ও অনিয়মের জটিল অঙ্ক।
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|