|
|
|
|
রবীন্দ্রনাথেই হৃদয় রাঙাচ্ছেন নন্দলালের ছাত্র |
অশোককুমার কুণ্ডু • আরামবাগ |
আজ, জন্মাষ্টমীতে আশিতে পা দেবেন হরিপ্রসাদ। কে বলবে?
সকাল থেকে রাত গ্রামের ছেলেমেয়ে, তরুণ-তরুণীদের নিখরচায় আঁকা শেখাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের গান তোলাচ্ছেন। কখনও রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের জন্য কুশীলবদের তালিম দিচ্ছেন। কুড়ির যুবকের মতো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর আরামবাগের কালীপুরের হরিপ্রসাদ মেদ্যা। বলছেন, “যত দিন বাঁচব, এই গ্রামগঞ্জে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা, শিল্পকর্ম, গান পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। মাস্টারমশাইয়ের তেমনই নির্দেশ।”
‘মাস্টারমশাই’ অর্থাৎ, শিল্পী নন্দলাল বসু। শান্তিনিকেতনে তাঁর কাছেই হরিপ্রসাদবাবুর শিল্পে দীক্ষা। পরিবারের লোকজন চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু ব্যাঙ কাটতে গিয়ে তাঁর গা এমন শিউরে ওঠে যে কালীপুর কলেজে আইএসসি-র পাঠ শেষ করেই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান শান্তিনিকেতন। সেটা ১৯৫৩ সাল। বছর ছ’য়েক সেখানে শিল্পকর্মের নানা শিক্ষাগ্রহণ। পাঁচের দশকের শেষে হরিপ্রসাদ পাড়ি দিলেন বেনারস। সেখানে অ্যানি বেসান্ত কলেজে পাঁচ বছর শিল্প শিক্ষক হিসাবে চাকরি করেছেন। ১৯৬৪ থেকে ’৬৬ কোয়ম্বত্তুর ইন্টারন্যাশনাল কলেজেও একই চাকরি। কিন্তু মন টিকছিল না। সব ছেড়েছুড়ে চলে আসেন কালীপুরে। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে এই গণ্ডগ্রামে গড়ে তুলেছেন নিজের ‘শিল্প নিকেতন’। হরিপ্রসাদের কথায়, “মাস্টারমশাই বারে বারে বলতেন, যেখানেই যাও, যা কিছু করো, গ্রামের বাচ্চাদের ছবি আঁকা শিখিও। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথকে পল্লির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিও। বাইরে থাকার সময়ে এই কথাটাই আমাকে তাড়া করত। তাই চলে আসি।” |
|
ছবি আঁকায় ব্যস্ত হরিপ্রসাদ মেদ্যা। ছবি: মোহন দাস। |
কালীপুরে হরিপ্রসাদের মামারবাড়ি। ভরপুর প্রাচুর্য। ছেলেবেলা থেকে হরিপ্রসাদ এখানেই। পুইন গ্রামে তাঁদের নিজেদের বাড়ি। তবে সেখানে বেশি দিন থাকেননি। প্রথম থেকেই তাঁকে টেনেছিল কালীপুরের প্রকৃতি, গ্রামবাসীদের সরল-সহজ জীবনযাপন, যা শান্তিনিকেতনে গিয়ে আরও বড় ভাবে ধরা দিল তাঁর কাছে। শান্তিনিকেতন থেকে মামাদের চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি এখানেই শিল্পচর্চা করব। নন্দলাল বসু, মাস্টারমশাই তাঁর পায়ে স্থান দিয়েছেন’।
এখন এক ডাকে কালীপুর এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষচেনেন হরিপ্রসাদবাবুকে। কত যে তাঁর ছাত্রছাত্রী! বাইরের চাকরি ছেড়ে কালীপুরে এসে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছিলেন। বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে যান গোবিন্দপুর হাইস্কুলে। দশ মিনিটে প্রধান শিক্ষক এবং সম্পাদকের ছবি এঁকে দেন। মুগ্ধ হয়ে তাঁরা তখনই তাঁকে কর্মশিক্ষার শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সেখানেই চাকরি করে অবসর নেন হরিপ্রসাদ।
চাকরিতে অবসর হলেও কাজে অবসর নেননি। বরং তা আরও বেড়েছে। কেনা রং দিয়ে ছবি আঁকা শেখাতে হয় বলে বৃদ্ধের আক্ষেপ, “আজকাল আর কাঠবিড়ালির লেজ দিয়ে তুলি বাঁধতে পারি না। আর্থ-কালার তৈরি করতে পারি না। তাই কেনা রং-তুলি দিয়েই ছবি আঁকি। তবে আর্থ-কালার পেলে মন বড্ড ভাল হয়ে যায়। শান্তিনিকেতন-কলাভবনের স্মৃতি ফিরে আসে।”
এক সময়ে হরিপ্রসাদের হাতে আরামবাগ-কালীপুর সম্ভবত প্রথম দেখেছিল ফেব্রিকের কাজ এবং শাড়ি ছাপা। দেখেছিল চামড়ায় আঁকা কাজ। বন্যার সময়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ইজেল ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়তেন। তাঁদের বন্যার ছবি আঁকা শেখাতেন। এ ভাবেই চলত গ্রাম পরিক্রমা, মন্দির বা মেলা-পরব দর্শন। সাতের দশকের গোড়ায় অধ্যাপক অম্বুজ বসুর সঙ্গে গড়ে তুললেন সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘আরামবাগ সাহিত্য ও শিল্প পরিষদ’।
অকৃতদার মানুষটির কাছে কাজের অনুপ্রেরণা, রবীন্দ্রনাথ। শিল্পীর কথায়, “রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসি বলেই কাজে ক্লান্তি আসে না। এটা গুরুদক্ষিণাও বলতে পারেন।” |
|
|
|
|
|