আজকাল একটু কমেছে কিন্তু কয়েক বছর আগেও নির্বাচনের সময়, দিন-দুপুরে বেল বেজে উঠত, আর দেখা যেত দুয়ারে হাত জোড় করে ভোট-প্রার্থী, সঙ্গে বিনয় ও একটি অভিজাত গাঁধী টুপি। প্রার্থী নিজে খুব একটা বলতেন না কিছু, তিনি তো তখন নুয়ে পড়ছেন সেই বিনয়ের চাপে। বলতেন তাঁর সহকারীরা, কিন্তু আমাদের (আপনাদেরও নির্ঘাত) চোখ অনায়াসেই টেনে নিত ওই
টুপিটি। পাঁচ কিলেমিটার দূর থেকে কিছু দেখা যাচ্ছে না (সম্ভবও না), শুধু একটা সাদা গাঁধী টুপি, ব্যস আমরা বুঝে যেতাম, পলিটিক্স আসছে।
মহাত্মা গাঁধীকে ছবিতে, টিভিতে, নিভৃতে প্রায় কখনই এই টুপি পরে থাকতে দেখা যায়নি। তা-ও কেন এটির নাম হল গাঁধী টুপি? উত্তর খুঁজতে ফিরতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাঁকে যখন সেখানকার জেলে আটকে রাখা হয়, তখন অন্য ‘নিগ্রো’দের মতো মোহনদাস গাঁধীকেও এক রকম টুপি পরতে হত। এক রকম চিহ্ন, যে তুমি কয়েদি। তুমি আলাদা। তুমি আর যা-ই হোক মাথা উঁচু করে হাঁটবে না। |
কিন্তু ভারতীয়রা তো আদি কাল থেকে যখনই মাথায় কিছু চাপিয়েছে, তখনই তার মধ্যে একটা গর্বের ছোঁয়া থেকেছে। ভেবে দেখুন, পাগড়ি খুলে অন্যের পায়ের কাছে রেখে দেওয়ার মধ্যে কতটা মান খোয়ানোর কষ্ট আছে? কোনও রাজাও তো অভিষেকের সময় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কখন তার মাথায় সোনার মুকুট উঠবে, কখন। এমন পরিবেশে বড় হওয়া এক জন মানুষকে যখন রোজ এমন এক টুপি পরতে হয়, যা লজ্জা ছাড়া আর কিছুই জোগাবে না তাকে, তখন হয় সে চিরতরে কুঁকড়ে যায়, নয় সেটাকেই আপন করে কোনও আলাদা এক মুহূর্তে ভোল পাল্টে নেয়। গাঁধী মহাত্মা হয়েছিলেন সহজেই, কারণ তিনি এই পরের কাজটাই অবলীলায় করে ফেলেছিলেন।
ভারতে ফিরে তিনি দেখলেন বয়কট, স্বদেশির হাওয়া উত্তাল করে রেখেছে এ গলি সে গলি। মানুষ কিছুতেই আর বিদেশি কাপড়, বিদেশি সামগ্রী ছুয়ে দেখতে রাজি নয়। সে সব ঢালাও পুড়িয়ে ফেলতেও মানুষ পিছপা নয়। কিন্তু পুড়িয়ে ফেললেই তো হবে না, একটা বিকল্প অবস্থাও তো তুলে ধরতে হবে। প্রথমেই এল খাদি। এর পাখায় উঠে ক্রমে উড়ান পেল তীব্র জাতীয়তাবাদ। আর সেই হাওয়া-সরণিতে পা মিলিয়ে মহাত্মা গাঁধী আনলেন এই ধরনের টুপির চল। যে টুপি সর্বদাই এক জনের মাথাকে আরও আরও উঁচু করবে, দৃশ্যত। এটিই চিহ্ন হবে আত্মসম্মানের।
ভাববেন না, গাঁধী এমনিই এই টুপির কথা ভেবেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, এই ধরনের কাশ্মীরি টুপি বেশ কাজে লাগবে। দেখতে জবরজং নয়, হাল্কা, ভাঁজ করা যায়, তাই সহজে কেচে ইস্ত্রি করাও যাবে, আর কী চাই? কিন্তু কোনও রং-ই তাঁর মনে ধরছিল না, তখন তিনি ঠিক করলেন, রং হোক সাদা। স্বচ্ছতার রং, শুদ্ধতার রং, সত্যির রং।
এই টুপির সঙ্গে জুড়ে আছে একটা সংগ্রামী মনন, একটা অন্য চেতনা। সেগুলো আজ কেন খুঁজে পাচ্ছি না, সে ভেবে লাভ নেই। গাঁধী টুপিও ধীরে ধীরে আর বিকোচ্ছে না, এমনকী স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালেও নয়। কাল নয় পরশু এ-ও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। হলে হয়ে যাক, এখনকার অপমান নিয়ে বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? গাঁধী টুপি পরে মাথা উঁচিয়ে কোনও ভদ্রলোকের সিপিয়া ছবি, তার চেয়ে ঢের ভাল। |