লর্ড কার্জন কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে ঘোষণা করলেন, বাংলা ভাগ হবে। ১৯০৫ সাল। লাটসাহেবের প্রয়োজন, অতএব হবেই। বাঙালি এর অনেক আগে থেকেই পিছনে, আরও পিছনে তলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তা বলে, তীব্র ঝড়ের মধ্যেও এমন ঘা আসবে, আশা করেনি। এ বার তা হলে? জেগে উঠতে হবে। কিন্তু বছরের পর বছর অকেজো থাকার পর, দুম করে এক দিন জেগে ওঠা যায় কি? জেগে উঠে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনা এক জিনিস আর অন্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা, সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। বাঙালিদের এই পরের কাজটাই করতে হত। মানে লড়াই ছিল মূল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই। দু’এক জন কখনও না কখনও ওদের সঙ্গে লড়ে গিয়েছেন, কিন্তু বঙ্গভঙ্গ ঠেকাতে গেলে তো সবাইকে সামনে আসতে হবে।
যে দিন থেকে এই নিয়ম কার্য়কর হল, সে দিন বাংলার কোনও ঘরে উনুন জ্বলেনি। ছোট, বড়, এমনকী অন্দরমহলের বাসিন্দারাও দ্বিধাহীন ভাবে সে দিন খোলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন, মুখে বন্দে মাতরম্। মন্ত্রোচ্চারণের মতো। সে মিছিলে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। তাঁর মুখেও তখন বন্দে মাতরম্। মুহূর্তের মধ্যেই একটা জাতি অতীতের মার খাওয়া অভ্যেস ভাসান দিয়ে, সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা আর অত সহজ নেই, সাবধান। |
আমরা ভাঙব, তবু মচকাব না। বাঙালিকে এই গলার জোর দিয়েছিল বন্দে মাতরম্। না শুধু গলার না, মনের জোরও। ১৯০৫ ছেড়ে ১৮৭২-এ পিছিয়ে গেলে দেখবেন, বঙ্কিমচন্দ্র এই কবিতার প্রথম দু’স্তবক বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে লেখেননি। এটা ছিল নিজের সঙ্গেই এক অন্তরঙ্গ কথোপকথন। সে সময় ইংরেজ সরকার চেষ্টা চালাচ্ছিল যাতে তাদের ‘গড সেভ দ্য কুইন’ এখানেও মুখে মুখে ঘোরে। বঙ্কিমের মনে হয়েছিল হয়তো নিজেদের যদি এমন কিছু একটা থাকত?
কিন্তু এই ‘নিজেদের’ বলতে ঠিক কী? দেশ? না, সে সময় একটা নির্দিষ্ট বাউন্ডারি গিয়ে ঘেরা দেশের ভাবনাটাই আমাদের ভেতর জাগেনি। ‘নেশন’ কনসেপ্টটা ফরেন আমদানি। আর তাই বুঝতে হবে যে, বঙ্কিমচন্দ্র’র এই সৃষ্টিকে জন্ম লগ্নেই জাতীয়তাবাদী ছাপ্পা লাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বঙ্কিম ওই দুটি স্তবকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এক ভারত মায়ের কথা। যে মা সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা শস্যশ্যামলা। কিন্তু এই মা’কে ইংরেজদের পদতলে দেখাননি। আরও দেখা যাবে যে এই কবিতা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয় ১৮৮১ সালে, যখন আরও চারটি স্তবক বাড়িয়ে বন্দে মাতরম্, আনন্দমঠ উপন্যাসের অংশ হয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে বন্দে মাতরম্ প্রথম খোলাখুলি কোনও সংঘর্ষের ইঙ্গিত দেয়। সেখানে ভারত মা দশপ্রহরণধারিণী হচ্ছেন, সপ্তকোটি সন্তানের নিনাদের মাঝখানেই আমরা শুনতে পাচ্ছি, ‘কে বলে মা তুমি অবলে...’
আনন্দমঠে সংঘর্ষের কথা থাকলেও, সেটা কোনও দেশের কথা ভেবে নয় কিন্তু। দেশের ছায়া গলায় ধীরে বসতে শুরু করে ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে। ১৮৯৬ সালের কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে যখন রবীন্দ্রনাথ নিজে সুর লাগিয়ে এ গান গাইলেন, তখন। তার পর তো একে একে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর-এর বিপ্লবীরা এটিকে মন্ত্ররূপে আত্মস্থ করে নিলেন আর বন্দে মাতরম্, দেশ গঠনের অস্ত্রে পরিণত হল। পরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ এ গানের হিন্দু চিত্রকল্পসমূহ নিয়ে বেশ কিছু আপত্তি তোলেন, কিন্তু এ গানের ম্যাজিক খর্ব হয়নি। যদু ভট্ট পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে এ.আর রহমান, সবাই গানটিকে আরও কত যে উঁচু নোটে বেঁধেছেন।
তবে আমরা তো দেশকে সব ক্ষণেই মা হিসেবে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথও প্রথম প্রথম দেখেছিলেন (আমার সোনার বাংলা), কিন্তু শেষে তাঁর ‘জন গণ মন’ যখন জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হল, তখন দেখলাম দেশকে ‘ফাদারল্যান্ড’ রূপে দেখা হয়েছে। |