|
|
|
|
সমকাম, মুক্তচিন্তা, ইচ্ছামৃত্যু’র ১৫ অগস্ট |
স্বদেশি আন্দোলন আমাদের কাছে স্বাধীনতার সমার্থক। তবে কিনা, ব্যক্তির স্বাধীনতা জীবন, যৌনতা, চিন্তা,
বিশ্বাস, অবিশ্বাস, অধর্ম, এমনকী মরণের মুক্তি অবধি ব্যাপ্ত। তিন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কুর্নিশ। |
তবু আমি নারীকেই চাই
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
|
তাঁর জীবনের কথা নিশ্চিত করে প্রায় কিছুই জানা যায় না। তাঁর বহু কবিতার বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে, বেঁচে আছে টুকরো টুকরো কিছু লাইন, তারও অনেকটাই আবার অন্যের উদ্ধৃতিতে। কিন্তু তিনি আছেন। এবং থাকবেন। থাকবেন স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে। ভালবাসার স্বাধীনতা। নিজের ইচ্ছা, রুচি, পছন্দ মতো ভালবাসা। আমাদের চেনা কথায় বললে সমকামীর স্বাধীনতা। সমকামিতার, সমকামনার স্বাধীনতা। সমাজ যে ভালবাসাকে স্বীকার করে না, তুচ্ছ করে, হেয় করে, এমনকী ঘৃণ্য বলে মনে করে, সেই ভালবাসাকে সসম্মান স্বীকৃতি দেওয়ার অধিকার দাবি করেন যাঁরা, গ্রিক কবি স্যাফো (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৬২৫-৫৭০) তাঁদের আরাধ্য। তার কারণ, এই নারী স্বাধীন ভালবাসার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সুতীব্র, আবেগমন্দ্র, আশ্লেষঘন প্রেমের কবিতাগুলিতে ছত্রে ছত্রে নারীর প্রতি ভালবাসা।
নারী হয়ে নারীকে ভালবাসার এই অকুণ্ঠ ঘোষণা সমাজ পছন্দ করে না। সমাজ বলে এসেছে, আজও বলে চলেছে, পুরুষ নারীকে ভালবাসবে, নারী পুরুষকে এটাই স্বাভাবিক, কারণ এটাই পুরুষ এবং নারীর স্ব-ভাব। কী করে জানা গেল, এটাই স্বভাব? সহজ উত্তর: বেশির ভাগ মানুষ এমনটাই করেন, তাই। বেশির ভাগ মানুষ যা করেন, সেটাই তো নিয়ম, সেটাই তো মেনে চলতে হবে, তাই না? ‘মানব না, আমি আমার মতো থাকব, আমি আমার মতো ভালবাসব’ এই কণ্ঠস্বর স্বাধীনতার। এই স্বর বলে, ‘আমি অন্যের অধীন নই, আমি স্ব-অধীন।’ দুনিয়ার সমকামী মানুষ বহু যুগ ধরে সমাজের বেশির ভাগের শাসন এবং পীড়ন মেনে নিয়েছেন, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আজও সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য শেষ হয়নি বটে, কিন্তু অচলায়তনে ভাঙন ধরেছে, বন্ধ দরজায় আঘাত পড়ছে, খুলছেও সেই দরজা, একটু একটু করে। |
|
সমকামী মানুষ নিজস্ব ভালবাসার অধিকার দাবি করছেন, দাবি করছেন তার সম্মান এবং স্বীকৃতি, খুঁজছেন তার প্রতীক। আর তাই, আড়াই হাজার বছর আগের সেই কবিকে তাঁরা আজ পূর্বসূরি হিসাবে শ্রদ্ধা করেন, তাঁর জন্মভূমিকে তীর্থ মনে করেন। নানা দেশে তাঁর নামে সমকামী মানুষের নিজস্ব সংগঠন তৈরি হয়েছে, হয়ে চলেছে। এই কলকাতা শহরেও।
কোথায় ছিল স্যাফোর জন্মভূমি? গ্রিসের পূর্ব প্রান্তে, তুরস্কের খুব কাছাকাছি, ইজিয়ান সমুদ্রের একটি দ্বীপ লেসবস। সম্পন্ন ঘরের মেয়ে, নিয়ম মতো লেখাপড়া শিখেছিলেন, মেয়েদের সাহিত্যচর্চাও অজানা ছিল না প্রাচীন গ্রিসে। কবিতার ভাষা এবং শৈলীর বিচারে স্যাফো অ-সাধারণ বলেই গণ্য হয়েছেন। তবে তাঁর কবিতার আলোচনায় সবচেয়ে বেশি করে এসেছে তাঁর ভালবাসার ধর্ম। সেই ভালবাসায় স্নেহ, আবেগ, বিরাগ, ঈর্ষা পরিচিত সমস্ত বোধই মিশে রয়েছে। স্যাফোর কবিতাকে তাঁর জীবনের প্রকাশ হিসাবে দেখা বিপজ্জনক, সে কথা বিশেষজ্ঞরা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আনুষঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ থেকে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তাঁর চার পাশে থাকতেন তাঁর অনুরাগিণীরা, তাঁদের সঙ্গে স্যাফোর সম্পর্ক অনেক সময়েই ছিল আবেগমন্দ্রিত। কেউ মনে করেন, তিনি সহচরীদের নানা বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতেন, এমনকী একটি ‘ফিনিশিং স্কুল’ গোছের সংগঠনও ছিল তাঁর। আবার কারও মতে, তিনি ছিলেন সমকামী প্রেমের প্রচারক এবং শিক্ষক। এবং সেই কারণেই সমাজ তাঁকে ভাল চোখে দেখত না। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন গ্রিসের সমাজে পুরুষের সমকামিতা স্বীকৃত ছিল, স্বয়ং সোক্রাতেস-এর যৌন-পছন্দ এ কালের রক্ষণশীলদের ‘স্বাভাবিকতা’র ধারণার সঙ্গে মিলবে না মোটেও। কিন্তু সমকামী মেয়েদের নিয়ে সেই অতীতেও সমস্যার শেষ ছিল না। স্যাফোকে সে জন্য সামাজিক পীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল কি না, জানার কোনও উপায় নেই, তবে তাঁকে ‘স্বাভাবিক’ প্রমাণ করার নানান চেষ্টা পরে হয়েছে, এমনকী পুরুষ প্রেমিকের বিরহে তিনি আত্মবিসর্জন দেন, এমন কাহিনিও কোনও প্রমাণ ছাড়াই এক সময় প্রচলিত হয়েছিল।
স্যাফো কোনও বিদ্রোহ করেননি, সমাজবিধি এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর ডাক দেননি। নিজের মতো জীবন যাপন করেছেন, নিজের মতো কবিতা লিখেছেন। এবং, হয়ে উঠেছেন সমকামী মানুষের স্ব-অধীনতার, নিছক প্রতীক নয়, আদর্শ। আত্মসচেতন সমকামিতার এক পথিকৃৎ। তাঁর বাসভূমি ‘লেসবস’ দ্বীপের নাম থেকেই তৈরি হয়েছে একটি শব্দ: লেসবিয়ান। |
পৃথিবীই সূর্যের চার দিকে ঘোরে
আশীষ লাহিড়ি |
সূর্যই সৌরব্যবস্থার কেন্দ্রে। কথাটা বলেছিলেন কোপার্নিকাস, প্রমাণ করেছিলেন গালিলেয়ো। আর, এই কথাটা বলার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন জিয়োর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০)। ব্রুনো কীসের জন্য শহিদ হয়েছিলেন? বিজ্ঞানের জন্য? না কি, স্বাধীনতার জন্য? চিন্তার স্বাধীনতা? বিজ্ঞানের ইতিহাস কী বলে?
ব্রুনো যেন কোপার্নিকাস আর গালিলেয়োর মাঝে এক হাইফেন। ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাস যখন বললেন, পৃথিবী নয়, সূর্যই রয়েছে সৌরব্যবস্থার কেন্দ্রে, তখন অনেকেই তা মানতে পারেননি। একে তো কথাটা অ্যারিস্টটল-বিরোধী এবং বাইবেল-বিরোধী, তার ওপর কোপার্নিকাসের যুক্তি আর অঙ্ক যথেষ্ট নিশ্ছিদ্র ছিল না। সেই পাকাপোক্ত অঙ্ক আর যুক্তির জন্য মানুষকে গালিলেয়ো অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। |
মাঝখানের এই পর্বটাতে রেনেসাঁসের সন্তান ব্রুনো কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের সারবস্তুকে ছড়িয়ে দিলেন ইয়োরোপ জুড়ে। ব্রহ্মাণ্ড যে অনাবদ্ধ (ওপেন), পৃথিবী তার একটা ক্ষুদ্র অংশমাত্র, এই ধারণাটাই তো তখন খ্রিস্টীয় জগতে বিস্ফোরক। বহু দিনের স্বীকৃত ধারণা ছিল, আবদ্ধ (ক্লোজ্ড) অজস্র এককেন্দ্রিক স্ফটিক-গোলক দিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ড তৈরি। ঈশ্বরই তার স্রষ্টা, তিনিই তাকে গতিশীল রেখেছেন। অ্যারিস্টটলও সে কথাই বলে গিয়েছিলেন। বাইবেলের সঙ্গেও দিব্যি মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সেই কথা। অতএব, সূর্য নয়, ঘুরছে পৃথিবীটাই কী করে মানবে স্থিতাবস্থার পূজারিরা? বার্নাল লিখেছেন, ‘খ্রিস্টীয় অর্থে কালাপাহাড়ি এই ভাবনারই খেসারত দিতে গিয়ে ব্রুনোকে মরতে হয়েছিল।’ দূরপ্রসারী কল্পনাপ্রতিভা আর সংবেদনশীলতার অধিকারী এই মানুষটির জন্ম নেপলস-এর কাছে নোলা’য়। প্রথমে এক মঠেই যোগ দিয়েছিলেন ব্রুনো। কিন্তু চিন্তার নিজস্বতা তাঁর এতই বেশি যে যে মঠের মহারাজদের সঙ্গে অচিরেই তাঁর খিটিমিটি বেধে গেল। বেরিয়ে পড়লেন। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব নিয়ে লিখলেন একের পর এক পুস্তিকা আর বই, ঝাঁকিয়ে তুললেন বিতর্কের পর বিতর্ক। অতুলন বাগ্মিতা তাঁকে দেখতে না দেখতে খুব জনপ্রিয় করে তুলল। কিন্তু মানুষটা ছিলেন বড় ঠোঁটকাটা। প্রফুল্লচন্দ্রের ভাষায় ‘এ্যা-ও হয়, অ-ও হয়’ বলার লোক তিনি ছিলেন না। ফলে খ্যাতি যত বাড়ল, তার চেয়ে বাড়ল শত্রুর সংখ্যা। সবচেয়ে বড় শত্রু ক্যাথলিক চার্চ। হাতে পেলে তাঁকে শেষ করে ফেলবে তারা। বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ১৫৯২ সালে ভেনিসে এলেন এই চির-ভ্রাম্যমাণ মানুষটি। তক্কে তক্কে থাকা বিশ্বাসঘাতকরা তাঁকে তুলে দিল রোমান ধর্ম-আদালতের (ইনকুইজিশন) হাতে। ‘বিধর্মিতা’র, অর্থাৎ চার্চ-বিরোধিতার অভিযোগে আট বছর ধরে তাঁর ‘বিচার’ হল। প্রকাশ্যে দগ্ধে দগ্ধে পুড়িয়ে মারার রায় দিল বিচক্ষণ বিচারকরা। চুরি করেননি, খুন করেননি, তলোয়ার হাতে বিদ্রোহ করেননি, শুধু যুক্তি-তর্ক আর দর্শনের কথা বলেছিলেন, মনটাকে খোলা রাখতে বলেছিলেন। তাঁকেই এত ভয় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পূজারিদের। |
ব্রুনো বিজ্ঞানী ছিলেন না। হাতেকলমে কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি তিনি, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ করেননি, শুধু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিজ্ঞানের তথ্যাবলি থেকে ‘আপন পছন্দমত’ সিদ্ধান্ত বেছে নেওয়ার অধিকার ঘোষণা করে গিয়েছেন। আপন পছন্দমত, অর্থাৎ ক্যাথলিক চার্চের পছন্দমত নয়। সে কালে সেটা যে কত বিপজ্জনক ছিল, ব্রুনোর জীবনের ভয়ঙ্কর পরিণতি তার সাক্ষী। ব্রুনো শহিদত্ব বরণ করেছিলেন যতটা না বিজ্ঞানের সপক্ষে লড়াই করে, তার চেয়ে বেশি চিন্তার স্বাধীনতার সপক্ষে লড়াই করে। দুটো এক কি না, তা নিয়ে কিছু কাল আগেও কারও সংশয় ছিল না। ইদানীং সংশয় দেখা দিয়েছে।
অত্যাচারী প্রাতিষ্ঠানিকতা চেয়েছিল, ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি দিয়ে মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধ করতে। তারা জানত না, এখনও জানে না, জীবনের ধন কিছুই ফেলা যায় না। ব্রুনোর প্রাণদণ্ড দেখে যত জন মানুষ ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি মানুষ বাড়তি উৎসাহ পেয়ে রথের রশি তুলে নিয়েছিল হাতে।
|
|
বাহান্ন বছর বয়সে ব্রুনো যখন প্রকাশ্যে পুড়ে মরছেন, গালিলেয়ো তখন ছত্রিশ। ১৬৩২ সালে বেরোল তাঁর যুগান্তকারী ‘কথোপকথন’। পূর্ণ হল চক্র। কোপার্নিকাসের অপূর্ণ অনুমান পূর্ণ তত্ত্বের মর্যাদা পেল। ভাঙল জীর্ণ পুরাতনের রাজত্ব। সেই ভাঙনের আগমনী গেয়েছিলেন ব্রুনো।
মনে পড়ছে একটি কাহিনি। ১৮৯৮ সালে বৃদ্ধ মহেন্দ্রলাল সরকার মশাই দুঃখ করে বলেছিলেন, দেশে বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য তিনি ‘অনেক’ করেছেন, কিন্তু দেশের লোক তার উপযুক্ত কদর করল না। শুনে সাঁইত্রিশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘... অনেক করিয়াছেন বলিয়া বিলাপ না করিয়া তাঁহাকে যে আরও অনেক করিতে হয় নাই সেজন্য (দেশবাসীর প্রতি) কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত ছিল। বিজ্ঞানপ্রচারের উৎসাহে কোনো মহাপুরুষ জেলে গিয়াছেন, কোনো মহাপুরুষকে অগ্নিতে দগ্ধ হইতে হইয়াছে।’ রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা ঠিক ছিল কি না, সে বিচার আপাতত থাক। কিন্তু যে মানুষটি আমাদের গৃহের প্রাচীর-ভাঙা, ভয়শূন্য, উচ্চশির স্বাধীনতার বার্তা শুনিয়েছেন, অগ্নিদগ্ধ জিয়োর্দানো ব্রুনোর কথা তাঁর স্মরণে ছিল, এই কথাটি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি। |
আমার মৃত্যু শুধু আমার
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
|
মৃত্যু চিরকালই সব্বাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। এতটা সর্বগ্রাসী, এতটাই আকস্মিক, সে, যে তার সঙ্গে কোনও দরাদরি চলে না। সে আসবে সবাই জানে কিন্তু কখন আসবে, কেউ জানে না এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কেউ কেউ এই নিয়মকেও নিজের মতো ভাঙতে চায়। কেউ কেউ নিজের নিয়মে নিভতে চায়। সম্ভব? সম্ভব। অন্তত জ্যাক কেভরকিয়ান, মানে ডা.ডেথ (১৯২৮-২০১১) সেই লক্ষ্যে লড়েছিলেন।
অসহ্য যন্ত্রণার চোটে হয়তো আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এ বার আমিই যেচে ইতি টানতে চাই, সে-ও কি স্বাধীনতা নয়? আর সেই অধিকার কায়েম করার জন্যে লড়াই,
স্বাধীনতার লড়াই নয়? ১৯৯০ সালে যখন আমেরিকার জ্যানেট অ্যাডকিন্স জানলেন, তাঁর অ্যালজাইমার্স
ডিজিজ হয়েছে, তখন বেশি কিছু না ভেবে তিনি জ্যাক কেভরকিয়ান-এর কাছে এলেন। কারণ এ বার থেকে তো জ্যানেট স্রেফ এক রকম তেতো প্রদর্শনী। |
|
জ্যানেট আত্মহত্যা করেননি। ওতে আত্মসম্মান কই? একটা লজ্জার ছাপ রয়ে যায়... জ্যাক মৃত্যুর রাস্তা তৈরি রেখেছিলেন। নিজের তৈরি ‘থ্যানাট্রন’ ও ‘মার্সিট্রন’, সুইসাইড-এর দুই সহায়ক। জ্যানেট-এর হাতে ‘থ্যানাট্রন’-এর একটি পাইপ লাগিয়ে জ্যাক পাশে সরে এলেন। ড্রপ ড্রপ স্যালাইন ঢুকল তাঁর দেহে। জ্যানেট নিজেই দেখিয়ে দেওয়া বোতাম টিপলেন, স্যালাইন বন্ধ হয়ে থিয়োপেন্টাল ঢুকল, কোমায় চলে গেলেন জ্যানেট, এক মিনিট পর মেশিন থেকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড বেরিয়ে পুরোপুরি থামিয়ে দিল জ্যানেটকে। জ্যাক পুলিশ ডেকে দেখালেন সেই সুন্দর, ব্যথাহীন ইচ্ছেমৃত্যু।
সবাই বলল জ্যাক ডাক্তার নয়, খুনি। শুনে তো জ্যাক দিশাহারা। খুন মানে তো ব্যথা, শারীরিক মানসিক যা-ই হোক। কিন্তু এ মৃত্যুতে তো ব্যথা নেই, উল্টে নিস্তার আছে। স্বাধীনতা আছে। সর্বোপরি এ মৃত্যু তো কারও এক জনের কাঙ্ক্ষিত। তাও এটাকে খুন বলা হবে? তোলপাড় তার মতো জারি রইল। লোকে বলল, ব্যথা থেকে আরাম তো অন্য ভাবেও আনা যায়, তা বলে কেউ অধৈর্য হয়ে মৃত্যু চাইলে, তাকে সাহায্য করা কি ঠিক? কেস ঠুকে দেওয়া হল মুহুর্মুহু। জ্যাক বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে প্রায় ১৩০-এর মতো ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ বা ‘ইউথানেসিয়া’-র কেস যত্ন নিয়ে সামলালেন।
মৃত্যু আর যত্ন এক খাপে বসে না, না? জানতাম। শুধু জ্যাক ভাবতেন আলাদা। ভাবতেন মৃত্যুকেও কী করে সহজ, সাবলীল করা যায়। আমার যেমন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, বিকল করে দেওয়া অসুস্থতা নিয়ে না-বেঁচে থাকারও তো অধিকার আছে, নেই? গুলিয়ে যায়। ভাবি, না বাঁচলে আর কী অধিকার ফলাব? ঠিক, কিন্তু যত ক্ষণ বাঁচছি, তত ক্ষণ পারি না? কে বলেছে অধিকার ফলাতে গেলে সুস্থ সবল শরীর প্রয়োজন? আপাত-নিষ্ক্রিয় হয়েও তো নিজের ভোট নিজেকে দেওয়া যায়। চেতনার আলতো ডাকে সাড়া দেব না? জীবনে প্রতি মুহূর্তে স্বাধীনতার বুলি আওড়েছি, তা হলে মৃত্যুর টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশ্নস, না দেখে সই করব কেন? না পোষালে খেলা ছেড়ে উঠে আসার তো আমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, তাতে কে কী ভাবল, আমি দেখব না।
কারণ আমি আমার জন্যেই বাঁচি। আমার কষ্ট একান্তই আমার। জ্যাক থাকলে বলতেন, দেখ, সেই শেষটা যেন শান্তিতে হয়। ব্যথা, বিরক্তি নিয়ে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। আর ও ভাবে বিকল হয়ে বেঁচে থাকলে জীবনের এথিক্সকেও অমান্য করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সহজ না হতে পারলে, জীবনের স্বাধীনতাও ধরা যায় না। সে সব অবশ্য আমরা বুঝেছি কবে? জ্যাক বুঝতেন, ইতি টানার স্বাধীনতা। |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|