|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে মেয়েদের ছবি |
ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী |
মার্গ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যার বিষয় ‘ফ্রেমিং উইমেন: জেন্ডার ইন দ্য কলোনিয়াল আর্কাইভ’ (অতিথি সম্পাদক নীহারিকা দিনকর, ৩৩০.০০)। ঔপনিবেশিক জমানায় মেয়েদের কী চোখে দেখা হত তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ‘ছবি’র ফ্রেমে মেয়েরা এই পর্বে কী ভাবে ধরা পড়েছেন তা নিয়ে এত খুঁটিয়ে দেখা বোধহয় এর আগে হয়নি। ‘ছবি’ এখানে সব থেকে ব্যাপক অর্থে বড় অংশ অবশ্যই জুড়ে আছে আলোকচিত্র, আলকাজি কালেকশন অব ফোটোগ্রাফির মতো নানা সংগ্রহ থেকে যার প্রচুর হদিশ পাওয়া যাচ্ছে, তা ছাড়া আঁকা ছবি, ছাপা ছবি, সিনেমা ও সিনেমা পোস্টার, বিজ্ঞাপন ও বিভিন্ন পণ্যের লেবেল, এমনই বিচিত্র সম্ভার। এই ‘দেখা’ অবশ্যই মূলত পুরুষের চোখ দিয়ে, কারণ মহিলা আলোকচিত্রীর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য, আর শিল্পীদের মধ্যেও ব্যতিক্রমী অমৃতা শের-গিল মেয়েদের তিনি দেখেছিলেন একেবারেই নিজের মতো করে, নিজের ধাঁচে।
ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ছায়ায় অন্তঃপুর থেকে ভারতীয় মেয়েদের ‘বাইরে’ আসা। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আলোকচিত্রের জগতে যেমন তাঁরা জায়গা করে নিয়েছেন (তার পিছনে যে কারণই থাকুক না কেন), তেমন বিংশ শতকের প্রথমার্ধে দৃশ্য-সংস্কৃতিতে ‘আধুনিকা’রা আছেন অনেকখানি জায়গা জুড়ে। এর পিছনে আছে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের জের এক দিকে বাহ্যিক প্রগতির চিহ্ন, অন্য দিকে আসলে সবই বিশ্বজোড়া ভোক্তা-সংস্কৃতির অঙ্গ। এর পাশাপাশি রয়েছে নারী-শরীর নিয়ে সেই চিরন্তন দ্বন্দ্ব ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, শ্লীল ও অশ্লীল, আর নতুন বুর্জোয়া সংস্কৃতিতে শালীনতার মাপকাঠি কী হবে তাই নিয়ে বিতর্ক। স্বভাবতই সেই বিতর্ক বিষয়টিতে জুড়ে দিয়েছে অন্য মাত্রা। এখান থেকেই উঠে আসে আরেকটি প্রশ্ন, মেয়েদের এত গুরুত্ব কেন দেওয়া হচ্ছিল? সংকলনে এই সব প্রসঙ্গই এসেছে।
রাজপুত চিত্রকলায় মেয়েদের ছবি আঁকা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা খুব সীমিত সংখ্যক অভিজাতের দেখার জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। বস্তুত আলোচ্য পর্বে ছবি তোলা এবং মুদ্রণের প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ‘মেয়েদের ছবি’ খুব সহজে সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিল, যা তার আগে কোনও দিনই সম্ভব ছিল না। পত্রপত্রিকা এবং পণ্যের লেবেল, ক্যালেন্ডার ও পোস্টার, সিনেমা-থিয়েটারের ছবি এর সব থেকে বড় উদাহরণ। নীহারিকা দেখিয়েছেন, যৌনতাকে এ ক্ষেত্রে কী ভাবে কাজে লাগানো হয়। এক দিকে বিপুল ভাবে নারী-শরীরকে ব্যবহার করা হচ্ছিল, অন্য দিকে নারীসত্তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল ঔপনিবেশিক সম্মান-শালীনতার চোখ দিয়ে বিচার করে। অবশ্যই এ সব আসছিল এক বিশ্বায়িত সংস্কৃতির পথ ধরে। মেয়েদের কী ভাবে দেখানো হবে, তার উপর মেয়েদের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, এর পুরোটাই দৃশ্য-সুখের জন্য পুরুষের তৈরি করা জগৎ। আধুনিকতার এ এক বিতর্কিত ক্ষেত্র অতীতে সংস্কারপন্থীরা তর্ক করেছেন মেয়েদের যথার্থ পরিচ্ছদ কী হওয়া উচিত তাই নিয়ে, এখন আমরা আলোচনা করছি নগ্নতার প্রসঙ্গ।
সংকলনের বিভিন্ন লেখায় এই ধরতাই স্পষ্ট। যেমন, স্বাতী চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন নটী বিনোদিনীর আলোকচিত্র কী ভাবে তাঁর ‘বাইরের’ ও ‘ভিতরের’ সত্তাকে প্রকাশ করেছে, সূর্যনন্দিনী নারায়ণ খুঁজেছেন আদিযুগের স্টুডিয়োয় তোলা মেয়েদের ছবি, জি এম কারোটেনুটো দেখিয়েছেন দীনদয়ালের তোলা সপ্তম নিজামের ‘জেনানা’র আলোকচিত্রে কী ভাবে প্রাচ্য হারেম-এর ছায়া পড়েছে, বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশের দশকে মুম্বইয়ের ‘আধুনিক’ নায়িকাদের ছবি এঁকেছেন দেবশ্রী মুখোপাধ্যায়, মালবিকা কার্লেকর-এর আলোচনায় আছে ঊনবিংশ শতকে বাংলার মেয়েদের পোশাক-সংস্কার, রাজা রবি বর্মাকে নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ‘রঙ্গ রসিয়া’-র পরিচালক কেতন মেটার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নীহারিকা, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে মেয়েদের কথা তুলে এনেছেন ইউসুফ সঈদ, বীণা তলওয়ার ওলডেনবার্গ দেখিয়েছেন লখনউ-এর ‘তওয়াইফ’রা কী ভাবে ‘বাজারি’ হয়ে পড়লেন ঔপনিবেশিক শক্তির চাপে, আর আছে অমৃতা শের-গিলকে নিয়ে আলোচনা। অজস্র সুমুদ্রিত দুর্লভ ছবি এ সংকলনের সম্পদ। |
|
|
|
|
|