পুস্তক পরিচয় ১...
ভারতশিল্পের স্বল্পালোচিত অধ্যায়
দি এলিগ্যান্ট ইমেজ/ ব্রঞ্জেস ফ্রম দি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট ইন দ্য সিদ্ধার্থ কে
ভনশালি কালেকশন,
প্রতাপাদিত্য পাল। নিউ অর্লিন্স মিউজিয়াম অব আর্ট এবং মার্গ, ২৮০০.০০
শ্চিম ভূখণ্ডে, মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ভারতের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক কালের শিল্প-পরম্পরার অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার প্রতাপাদিত্য পাল। সংস্কৃতি-অভিমানী বাঙালি সমাজে এই নামটি বিশেষ পরিচিত নয়। সেটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রায় চার দশকের বেশি সময় জুড়ে ভারতশিল্পের প্রচার ও প্রসারে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা পেশাদারি জগতে সুপরিচিত। উত্তর আমেরিকার বেশ কয়েকটি বড় সংগ্রহশালায় কাজ করেছেন, মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভারতশিল্পের ইতিহাস পড়িয়েছেন এবং অবসরজীবনে অতন্দ্র নিষ্ঠায় আয়োজন করেছেন ভারতশিল্পের বহু প্রদর্শনী, লিখেছেন বিভিন্ন সংগ্রহশালার প্রামাণিক ক্যাটালগ, এবং সম্পাদনা করছেন মুম্বই থেকে প্রকাশিত শিল্পকলা বিষয়ক বিখ্যাত ‘মার্গ’ পত্রিকা।
প্রবীণ এই শিল্প-ইতিহাসবিদের সাম্প্রতিকতম গ্রন্থের বিষয় ভারতীয় ধাতুমূর্তি। নিউ অর্লিন্স নিবাসী, ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিদ্ধার্থ কে ভনশালি-র ব্যক্তিগত সংগ্রহভুক্ত ধাতুমূর্তিগুলির একটি নির্ভরযোগ্য কুলুজি লিখেছেন প্রতাপাদিত্য পাল। সিদ্ধার্থ পেশায় চিকিৎসক, ব্যক্তিগত বিশ্বাসে জৈন ধর্মাবলম্বী এবং সংগ্রাহক হিসেবে মুক্তমতি ফলত তাঁর একক উদ্যমে একত্র হয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের, ভিন্ন ভিন্ন শিল্পশৈলীর বৈশিষ্ট্যযুক্ত ধাতুভাস্কর্যের এক অনবদ্য সংগ্রহ, সংখ্যায় যা সার্ধ-সহস্রাধিক। শুধু সংখ্যায় নয়, এই সংগ্রহ বিষয়বস্তুর বৈচিত্রে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্বের স্মারক রূপেও বিশিষ্ট। এরই একটি নির্বাচিত অংশ সম্প্রতি প্রদর্শিত হল নিউ অর্লিন্স মিউজিয়ম অব আর্ট-এ। ব্যক্তিগত সংগ্রহ-নির্ভর প্রদর্শনী কোনও অভিনব ঘটনা নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঘটনাচক্রের নিয়ামকের ভূমিকায় ছিল ২০০৫-এর বিধ্বংসী ক্যাটরিনা ঝড় সৌভাগ্যক্রমে ঝড়ের তাণ্ডব থেকে সিদ্ধার্থের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহটিও রক্ষা পায়। এর পরেই আসে সংগ্রহটিকে সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ভাবনা। তারই পরিণতি ওই প্রদর্শনী এবং প্রতাপাদিত্য পাল কৃত সুনিপুণ ধারাভাষ্য।
বিশাল সংগ্রহটি থেকে ক্যাটালগের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ১০৪টি নিদর্শন। একটি প্রাঞ্জল ভূমিকা এবং দুটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইটির প্রধান আকর্ষণ ধাতুমূর্তিগুলির আলোকচিত্র এবং মূর্তি-পরিচিতি। উত্তর ভারত, দাক্ষিণাত্য এবং দক্ষিণ ভারত সুপরিচিত এই ভৌগোলিক সীমানা ধরেই নিদর্শনগুলি সাজানো হয়েছে আরও এক ধাপ এগিয়ে বৃহত্তর ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক সীমার অন্তর্গত একাধিক সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের সঙ্গে ধাতুমূর্তিগুলির সম্পর্ক খোঁজা হয়েছে। উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে এই উপবিভাগগুলি হল, (১) প্রাক্-ইতিহাস পর্বের উত্তর ভারত, (২) ভারতীয় উপমহাদেশ-এর (যাকে আজকাল বলা হয় দক্ষিণ এশিয়া) উত্তর-পশ্চিমাংশ, মূলত গান্ধার অঞ্চল, (৩) উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার, (৪) ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও ওড়িশা এবং (৫) পশ্চিম ও মধ্য ভারত। অন্য দিকে, দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতের উপবিভাগগুলি হল, (১) অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, (২) তামিলনাড়ু ও কেরল। আছে সংস্কৃত নাম ও পারিভাষিক শব্দের একটি তালিকা এবং প্রাসঙ্গিক গ্রন্থপঞ্জি।
একটি সুসংহত ভূমিকায় লেখক ভারতে ধাতুভাস্কর্যের উদ্ভব ও বিকাশ, বিশেষত আঞ্চলিক শিল্পপরম্পরা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছেন অজস্র আলোকচিত্র সহযোগে। মহেঞ্জোদড়োয় পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের নর্তকী মূর্তি থেকে শুরু করে এই আলোচনায় এসে পড়েছে মহারাষ্ট্রের দায়মাবাদের খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের খেলনাগাড়ির হাতি, কুষাণযুগের মথুরা শৈলীর জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি, গান্ধার শৈলীর বুদ্ধমূর্তি শোভিত দেহাবশেষ-পেটিকা, এবং ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন বিশ্বাসে উপাসিত প্রতিমা ধাতবমূর্তির স্থানিক এবং শৈলীগত বিভিন্নতার স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন পাঠকের সুবিধার্থে। এই আলোচনায় এসেছে মূর্তি গড়ার কৃৎকৌশলের প্রসঙ্গ, শিল্পশাস্ত্রের উল্লেখ এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। এ সবের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে নান্দনিক অভিঘাতের প্রশ্ন, আনন্দ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে লেখক কুষাণ থেকে গুপ্তশৈলীর বিকাশ এবং তার প্রসারণের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহের ক্যাটালগের প্রারম্ভিক প্রবন্ধে বস্তুত ভারতের ধাতুভাস্কর্যের আনুপূর্বিক ইতিহাস ধরা রইল।
এই পদ্ধতির প্রসারণ ঘটেছে অন্যান্য অধ্যায়েও। মনে রাখা দরকার, ক্যাটালগভুক্ত নিদর্শনগুলির প্রাপ্তিস্থল অথবা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, কোনও কিছুই নিশ্চিত ভাবে জানা নেই। নিদর্শগুলি সংগৃহীত হয়েছে সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা বিক্রেতাদের কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রে, শিল্পশৈলীর নিরিখেই নিদর্শগুলির আঞ্চলিক পরিচিতি নির্ধারণ করা যেতে পারে। এটি খুবই কঠিন কাজ। বিগত এক শতাব্দীর গবেষণায় ভারতের শিল্প-ইতিহাসের প্রধান প্রধান পর্ব এবং তাদের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খানিকটা জানা গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ধাতু-ভাস্কর্যের স্থান-কাল নির্ধারণে এখনও রয়ে গিয়েছে নানাবিধ অনিশ্চয়তা। অন্য দিকে, ধাতুভাস্কর্যের ক্ষেত্রে শিল্প-পরম্পরা এবং করণ-কৌশলের অবিচ্ছিন্নতাও অনেক সময় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতাপাদিত্য পালের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ভারতশিল্পের প্রতিটি পর্যায় সম্পর্কে তাঁর গভীর বোধ এবং সংবেদনশীলতা এই কাজকে পরিশীলিত করেছে। সর্বোপরি এমন সব নিদর্শ এই ক্যাটালগে আলোচিত এবং চিত্রিত হয়েছে যাদের অস্তিত্ব এতদিন অজ্ঞাত ছিল। দু’একটি উদাহরণ দেওয়া অসঙ্গত হবে না: পৃষ্ঠা ৫০-৫৫ এবং চিত্র ১০-১৯-এর মধ্যে আলোচিত হয়েছে দশটি নিদর্শ, জৈন বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তি। এগুলির প্রাপ্তিস্থান অজ্ঞাত, তবে শৈলীর বিচারে এদের সঙ্গত ভাবেই স্থান দেওয়া হয়েছে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এদের কালক্রম খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় থেকে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত প্রসারিত। এতাবৎকাল আমরা জেনে এসেছি পূর্বভারতে প্রাচীনতম ধাতুমূর্তিগুলির সময়ক্রম দ্বিতীয়-তৃতীয় থেকে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক, এদের প্রাপ্তিস্থান বিহার প্রদেশের পশ্চিমে চৌসা-য়। পূর্বভারত থেকে পাওয়া প্রাক-নবম শতকের ধাতুমূর্তি অত্যন্ত বিরল। অন্য দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং অন্যান্য উপাদান থেকে সংগৃহীত তথ্যে এই অঞ্চলে প্রাক-অষ্টম-নবম শতকের জীবনের ছবি ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধরা যাক নালন্দার কথা। প্রাক্-পাল যুগে নালন্দার ইতিহাস জানা আছে বিভিন্ন সূত্র থেকে অথচ শিল্প নিদর্শনের (বিশেষত ধাতুমূর্তি) অপ্রতুলতার সমস্যার সমাধান হয়নি। বুদ্ধগয়ায় নালন্দার মতই প্রাক্-অষ্টম-নবম শতাব্দীর পাথরের মূর্তির কথা জানা আছে, অথচ ধাতুমূর্তির ব্যবহারের সাক্ষ্যপ্রমাণ গরহাজির। সারনাথে গুপ্তযুগে পাথরের মূর্তির প্রাচুর্যের পাশাপাশি ধাতুমূর্তির অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। শ্রীপালের আলোচিত কয়েকটি জৈন তীর্থংকর মূর্তি সম্ভবত চৌসা কিংবা চৌসা-অনুসারী শিল্পধারার সৃষ্টি, এমন অনুমান অযৌক্তিক হবে না। একই ভাবে একটি দণ্ডায়মান বুদ্ধ (চিত্র ১৬) এবং পদ্মাসন ঋষভনাথের (চিত্র ১৫) মূর্তিতে সারনাথ শৈলীর প্রভাব স্পষ্ট। বিহারের ষষ্ঠ শতাব্দীর সিংহবাহিনী অম্বিকা, উত্তরপ্রদেশের ওই শতকের দণ্ডায়মান অম্বিকাদ্বয়ের (চিত্র ১৭, ১৮) শৈলীগত অবস্থান অনেকটাই অনিশ্চিত। চিত্র ১৯-এর উমা-মহেশ্বরের সম্ভাব্য উৎস উত্তরবঙ্গ, এ কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিহার এবং বাংলার অষ্টম, নবম এবং দশম শতকের সর্বোৎকৃষ্ট কয়েকটি নিদর্শন এই বইয়ে দেখা যাবে (চিত্র ২১-২৩)। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়-র কাল নির্ধারণ নিয়ে একটু সমস্যা থেকে যায় মূর্তিটির ঈষৎ খাটো গড়ন সপ্তম শতকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য লম্বাটে গড়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সম্ভবত মূর্তিটির কালক্রম ঈষৎ পরবর্তী শতক। অন্য দিকে, চিত্র ৩০ ও ৩১-এর জৈন তীর্থংকর ঋষভনাথ এবং সানুচর বিষ্ণুমূর্তি দুটি সম্ভবত বিহারের কোনও প্রত্নস্থল থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। চিত্র ৩৬-এর ভৈরব (?) এবং গণেশ সহ দুই মাতৃকামূর্তি, আনুমানিক একাদশ শতকের, উৎসও সম্ভবত উত্তরবঙ্গ। একই ধাঁচের মাতৃকা ফলক পাওয়া গিয়েছে উত্তরবঙ্গের তপন থেকে অধুনা রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহালয়, কলকাতায় সংরক্ষিত। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের জগন্নাথ ও বলভদ্র এবং সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের গঙ্গা ওড়িশা এবং বাংলার অন্ত্য-মধ্যযুগের শিল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ (চিত্র ৩৯-৪০)।
অন্য অধ্যায়গুলিও সমান আকর্ষণীয়। সুমুদ্রিত আলোকচিত্র এবং অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য অথচ সুপাঠ্য ভাষ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ধাতুভাস্কর্যের সম্ভার উপস্থিত করেছেন শ্রীপাল। পশ্চিম ভারতের আকোটা, দক্ষিণ ভারতের পল্লব এবং চোল পর্বের মূর্তি, কেরলের মধ্য যুগের অতি-অলংকৃত ভাস্কর্য, উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিশিষ্ট রীতির নিদর্শ সব মিলিয়ে এক বিপুল দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা। শ্রীপালের ক্যাটালগ এক অর্থে ভারতের ধাতুভাস্কর্যের সার্বিক ইতিহাসের একটি প্রামাণিক ও সুপাঠ্য বই।
First Page Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.