ব্যাগ গুছিয়ে...

মেঘপিওনের সঙ্গে হাঁটা
গাড়ি থামল ছোট্ট কাঠের বাড়ির দরজায়। বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি রাস্তা ধরে ১১ হাজার ফুট উঠতে সন্ধে হয়ে গিয়েছে। বাড়ির ভিতরে ছোট্ট হলুদ বাল্ব। তার আলোতেই কিছুটা দেখা যাচ্ছে বাইরের রাস্তা। আশপাশ ঘন কালো।
অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে দেখা যায়, রাস্তার ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পরপর টিনের চাল দেওয়া দশ-বারোটা বাড়ি। পিছনের রাস্তাটা বাঁক নিয়ে উঠে গিয়েছে আরও একটু। বেশ শীত করছে। মালুম হচ্ছে, বাড়িগুলো সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে কোনও পাহাড়ের গায়ে।
রওনা হওয়ার আগে ফেসবুকে দেখা সাজানো-গোছানো স্বর্গের মতো ছবির সঙ্গে কোনও মিল নেই এ দৃশ্যের। ঝকঝকে সবুজ পাহাড়, রঙিন ফুল, সাজানো ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি নেই তার কিছুই। ইন্টারনেটে বন্ধুত্ব হওয়া চন্দু ভুটিয়াকেও যেন আট ফুট বাই দশ ফুট ঘরটায় ঢুকে এক্কেবারে অন্য রকম দেখাল। সঙ্গী বান্ধবী ফিসফিস করে বলল, “জুলুকের ছবিগুলো তো আরও অনেক সুন্দর ছিল রে!”
কোন ফাঁকে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবয়স্কা গৃহকর্ত্রী। চা-পকোড়া সাজিয়ে সযত্নে অতিথি আপ্যায়ন। পাশে বসা বান্ধবীর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকানো। কোনও স্টার হোটেল যে এ তল্লাটে নেই, তা জানানো হয়েছিল বটে, কিন্তু, পাহাড়ের বুকে ছোট্ট ছোট্ট যে বাড়িগুলো দেখা যায়, তা কেমন হয়, সে ধারণা কি ছিল তার? বান্ধবীর মুখটা একটু থমথমে। নতুন আস্তানা তো তেমন বিলাসবহুল নয়। তবে পাকোড়াটা বোধ হয় তার মনের মতোই হয়েছে।
বৃষ্টি এখানে বারো মাস না হলেও মাস ছ’য়েক তো থাকেই, ঘরের ভিতরে যাওয়ার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জানাল চন্দু। রাত বাড়ল, সঙ্গে বাড়ল বৃষ্টিও। রাত গড়িয়ে ভোর। বৃষ্টি থেমেছে। তবে জানলার বাইরে কুয়াশা পেরিয়ে দেখা যায় না আর কিছুই। মেঘ জমে রয়েছে বান্ধবীর মুখেও। চোখে জল এসেছে। সে যে বার বার জিজ্ঞাসা করেছিল, বর্ষার সময়ে পাহড়ে বেড়ানো যাবে কি না। সারা দিন তাকে ঘরে বসে থাকতে হবে না তো?
বেশ ভয় ভয়ই করছে এ বার। মাঠে মারা না যায় বান্ধবীর দুর্লভ ছুটি। নাম করা ট্যুরিস্ট স্পট ছেড়ে বান্ধবীটি সিকিমের এই ছোট্ট গাঁয়ে আসতে রাজি হয়েছিল শুধু ইন্টারনেটে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েই। কুয়াশা ঘেরা ভোরে সে ছবির কিছুই পাওয়া যাবে কি?
ফগ লাইট জ্বালিয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে ঘোরানো পথ ধরে শুরু হল জুলুক ভ্রমণ। কখনও মেঘের কাছাকাছি। কখনও মেঘকে নীচে রেখে আরও এগিয়ে। কিছু দূর গিয়ে গাড়িচালক পালদিন জানাল, সামনেই থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকেই দেখা যায় গোটা জুলুক। মেঘের আড়াল থেকে মাঝেমধ্যে দেখা দিচ্ছে আলো। বান্ধবীরও মুড বদলাচ্ছে অল্প অল্প।
আগের দিন শিলিগুড়ি থেকে জুলুক আসার পথে অসংখ্য বার গাড়ি থামাতে হয়েছে পালদিনকে। শুধু পাহাড়, ফুল, মানুষজন নয়। লিংথামে রাস্তার ধারে ধূপ জ্বালিয়ে টেবিল পেতে বসে লামাদের প্রার্থনা দেখেও ছবি তুলতে চেয়েছে যে পর্যটকেরা। তখন সে কোনও বিস্ময় প্রকাশ করেনি বটে, তবে আজ আর চুপ করে থাকতে পারল না। বান্ধবীটির আবদার শুনে সে অবাক। গাড়ি যাবে নিজের মতো আর পর্যটকদল যাবে পায়ে হেঁটে। এমনটা নাকি আগে কখনও দেখেনি সে।
কিন্তু বান্ধবীটিও এমন সুন্দর কুয়াশা-মাখা রাস্তা দিয়ে এর আগে হাঁটেনি যে কখনও। ঝকঝকে আকাশ দেখা যাক বা না-ই যাক, হাসি ফুটেছে। কুয়াশায় লুকোচুরি খেলা। পাথরের গায়ে ফুটে থাকা অজানা ফুলের ছবি তোলা। অনেকের মাঝে কুয়াশার আড়ালে একলা হয়ে যাওয়া।
এলাকাটি সংরক্ষিত। মাঝেমধ্যেই পাশ দিয়ে গড়গড় করে চলে যায় মিলিটারি ট্রাক, জিপ। আবার কখনও পায়ে হেঁটেই চলে যান এক দল ‘মেঘ যোদ্ধা’। হ্যাঁ, মেঘে-মাখা এই জায়গাটি আক্ষরিক অর্থেই থাকে মেঘ-যোদ্ধাদের পাহারায়। সেখানকার সেনাবাহিনীর নাম ‘দ্য ক্লাউড ওয়ারিয়র্স’।
পায়ে পায়ে পৌঁছনো গিয়েছে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। জুলুক তত ক্ষণে বেশ নীচে। দূরে দেখা যায় চার দিক পাহাড়ে ঘেরা ওই গ্রামটা। খুব বেশি হলে শ’তিনেক লোক থাকেন সেখানে, জানাল চন্দু। পঞ্চাশটির মতো ঘর। তবু গ্রামটা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
ভোর গড়িয়ে সকাল হয়েছে। হঠাৎ মাঝরাস্তায় গাড়ি থামাতে বলল চন্দু ভুটিয়া। সব্বাইকে নামতে হবে। সামনের সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গিয়েছে। আশপাশের সৌন্দর্যের তুলনায় সে রাস্তা তেমন কিছুই নয়। তবু চন্দুর তাড়নায় ঝকঝকে রাস্তা ছেড়ে ওই সরু পথে তখন সব্বাই। সবুজ ঘাসের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে সাদা ছোট ছোট স্ট্রবেরি ফুল। তার মধ্যে দিয়ে কিছু দূর নামতেই দিনের আলোতেও গা-ছমছম।
পর্যটকেরা তখন ‘সিল্ক রুট’-এ। পিছল রাস্তার মাঝে শুধু একটা লাল রঙের পুরনো মন্দির। সেখান থেকে রাস্তা আরও খাড়া। ঐতিহাসিক এই রাস্তা ধরে ব্যবসা করতে যাওয়ার সময়ে নাকি অনেকেই বিশ্রামের জন্য থামতেন জুলুকে। পথের ইতিহাসে ঘুরপাক খেতে খেতে বান্ধবীর প্রশ্ন, কোথা থেকে আসতেন ওই ব্যবসায়ীরা?
আরও কিছু দূর গিয়ে গাড়ি থামল ফের। সামনে একটা হাতির আকারের ঝকঝকে জলাশয়। নাম বিধানছু। গা বেয়ে উঠেছে পাহাড়। দূরে দেখা যাচ্ছে বরফ মাখা জেলেপ লা। বান্ধবীর মুখ উজ্জ্বল। ভুগোল বইয়ে পড়া আছে, ও পারে গেলেই তিব্বত। মনে পড়েছে ব্যবসায়ীরা কোথা থেকে আসতেন, কী আনতেন। সামনেই কুপুপ গ্রাম। সেখান থেকে আরও ভাল দেখা যায় জেলেপ লা। কলকাতার পর্যটকেরা তখন ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে। বরফে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। তারই একটার মধ্যে বসে ঘর গরম করার পদ্ধতি দেখে নতুন করে মুগ্ধ বান্ধবী।
চন্দুর ইচ্ছে মেমেনছু লেক দেখাতে নিয়ে যাবে সে দিনই। ততক্ষণে ক্লান্ত পর্যটকেরা। ভাঙাচোড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি যেন নামছে ৯০ ডিগ্রি কোণে। ভয় ও মুগ্ধতা মেশানো কণ্ঠস্বর বান্ধবীর। এখানকার মানুষদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাতে চায় সে। বাকি দু’টো দিন তাই অন্য কোথাও যাবে না। জুলুকের বাসিন্দাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই কাটাবে। প্রথম দিন থেকেই তো পর্যটকদের সঙ্গে গল্প করতে আগ্রহী তাঁরা।
ফের আসবে বান্ধবীটি এখানে। ছবির স্ক্রিপ্ট লিখবে সে বার এসে। ঠিক করেছে পরের বার থাকবে আরও ছোট একটা গ্রামে। নাম নাথান। ফেরার পথে সেখানে একটা বাড়ির সামনে সোনালি রঙের একটা পাহাড়ি কুকুর দেখে থামা হয়েছিল কিছু ক্ষণের জন্য। সন্ধে হয়ে এসেছিল, তাই ভাল করে গ্রাম ঘুরে দেখা হয়নি। ঠিক করে ফেলেছে সে পালদিনের এক বন্ধুর বাড়িতে থাকবে তখন। এ বার চন্দুর স্ত্রী বাড়িতে নেই। তাই পরের বার তাঁদের বাড়ি গিয়ে তিব্বতি খাবার ‘শাফালে’ বানানো শিখবে বান্ধবী।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে নিউ জলপাইগুড়ি অথবা শিলিগুড়ি।
সেখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা ছ’য়েকের পথ।
কোথায় থাকবেন
কোনও হোটেল নেই। স্থানীয় মানুষদের বাড়ি লাগোয়া পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
সঙ্গে রাখুন
জুলুক সংরক্ষিত জায়গা। মাঝরাস্তায় সেখানে যাওয়ার অনুমতিপত্র নিতে হবে।
তার জন্য দরকার সচিত্র পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
শীতপোশাক এবং ওষুধ রাখাও প্রয়োজন।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.