|
|
|
|
ডনের সেই ওভালে আউটের বল ৫৫ বছর নিখোঁজ |
গৌতম ভট্টাচার্য • বার্মিংহাম |
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত! সবচেয়ে আলোচিত ডেলিভারি বোধহয়! এত বছর বাদেও! ডন ব্র্যাডম্যানের জীবনের শেষ টেস্টে দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হয়ে যাওয়া!
শুক্রবার ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টির জাদুঘরে ডনের শেষ টেস্ট ইনিংসের ধারাভাষ্য চলছিল। দুষ্প্রাপ্য ধারাভাষ্য। সম্ভবত বিবিসি আর্কাইভ থেকে জোগাড় করা। কেননা অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যাডম্যান মিউজিয়ামেও নেই।
ভাষ্যকারের গলার ওঠাপড়া, তুমুল উচ্ছ্বাস থেকে শূন্যতায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া এত বছর বাদেও এমন নাটকীয় লাগে যেন এক্ষুনি এজবাস্টনে ঘটছে। সচিনদের ম্যাচেই হচ্ছে।
...অস্ট্রেলিয়া এক উইকেটে ১১৭। ওই ব্র্যাডম্যান নামছেন তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস খেলতে। ওই তো নর্ম্যান ইয়ার্ডলি তাঁর গোটা টিমকে জড়ো করে থ্রি চিয়ার্স দিলেন...ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, দু’টো স্লিপ রেখেছেন হোলিস সাক্ষাৎ ক্রিকেট কিংবদন্তির জন্য। কী চিৎকার! কী অভিনন্দন জনতার আপনারা শুনছেন। প্রথম বল ব্র্যাডম্যান ছাড়লেন অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে। পরের বল হচ্ছে। হয়তো এ বার আক্রমণে যাবেন ডন। আসছেন হোলিস। পিচ পড়ে ঘুরছে...বোল্ড। বোল্ড। ব্র্যাডম্যান বোল্ড জিরো। জিরোতে বিদায়... |
এরিক হোলিস। |
কানে হেডফোন নিয়ে কমেন্ট্রি শোনা শেষ করা মাত্র পাশের দেওয়ালে একটা ছবি দেখতে পাবেন। ছবির সঙ্গে ছোট মন্তব্য। টম ভোলারি বলে কোনও সহ-খেলোয়াড়কে খেলার পর বোলারের ফোন করা, “টম, বলটা ডন দেখতেই পায়নি।” উদ্ধৃতিটা যাঁর, ছবিও অবশ্যই তাঁর। ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টির অন্যতম বোলিং-রত্ন এরিক হোলিসের।
হোলিসের নামে বিশাল স্ট্যান্ড রয়েছে এজবাস্টন মাঠে। বহির্বিশ্ব ইংল্যান্ডের হয়ে ১৩ টেস্ট খেলা লেগস্পিনারকে জীবনের শেষ টেস্টে ব্র্যাডম্যান সংহারক বলেই জানে। হোলিস নিজে এই পরিচিতিকে অত পাত্তা দিতে চাননি। বলতেন, |
|
‘‘ডনের উইকেটটা নিছকই একটা মূল্যবান উইকেট ছিল। সারা জীবনে আমি দু’হাজারের ওপর উইকেট নিয়েছি। নটিংহ্যামশায়ারের বিরুদ্ধে তো এক বার ৪৬ রান দিয়ে দশ উইকেট নিয়েছিলাম। সেগুলো লোকে কেন ভুলে যায়!” যখন লোকে তবু জোরাজুরি করত, বলত ব্র্যাডম্যানের উইকেট ব্যাপারটাই আলাদা, তখন আশির দশকের গোড়ায় মারা যাওয়া হোলিস রীতিমতো রেগে যেতেন। বলতেন, “প্রথম বলেই ডনের আউট হওয়ার কথা। পুরনো ভিডিও ফুটেজটা গিয়ে দ্যাখো। অফস্টাম্পে হাওয়া লাগিয়ে ফার্স্ট বলটা চলে গিয়েছিল। ফার্স্ট বলটাও ও কিছু বোঝেনি।”
ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টির কাছে অবশ্য আজও ঘটনার তেষট্টি বছর বাদেও ব্র্যাডম্যানকে আউট করার বল ভীষণ গর্বের। প্রধান কারণ, এরা ইয়র্কশায়ার-ল্যাঙ্কাশায়ার বা মিডলসেক্সের মতো ক্রিকেটকুলীন কাউন্টি নয়। এরিক হোলিসের বলটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়ারউইকশায়ারের সর্বপ্রথম সেরা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন। দ্বিতীয়, নব্বই দশকের মাঝামাঝি কাউন্টির হয়ে এ মাঠে ব্রায়ান লারার করা ৫০১। লারা সেই ম্যাচের ব্যাট নিজে নিয়ে চলে গিয়েছেন। জাদুঘর পায়নি। কিন্তু দেশজ হোলিসের বলটাও যে তাদের সম্পত্তিতে নেই। হতাশা সেখানেই।
বল হারিয়ে যায় বার্মিংহামেরই একটা ক্লাব থেকে। ১৯৫৬ সালে। হোলিস যখনই কোনও ক্রিকেট টক শো-তে যেতেন, দর্শকদের অনুরোধে তাঁকে বলটা দেখাতে হত। এমনই একটা শো-তে গিয়েছিলেন স্থানীয় ক্লাবে। ভুলবশত বলতে ওঠার আগে বার-স্টুলের ওপর বলটা ফেলে রেখে যান। বক্তৃতার মাঝখানে খেয়াল হতে ফিরে গিয়ে দেখেন বল নিখোঁজ। আর আজ পঞ্চান্ন বছর ধরে তা নিখোঁজই রয়েছে।
ওয়ারউইকশায়ার জাদুঘরের গ্রন্থাগারিক ফিল ব্রাইট আনন্দবাজারকে জানালেন, পরবর্তী কয়েক বছর তন্নতন্ন করে খুঁজেও বলটা পাওয়া যায়নি। হোলিসের একমাত্র কন্যা সবচেয়ে উদ্যোগী বলটা খুঁজে বার করার জন্য। কাউন্টি কর্তৃপক্ষও নিজেদের স্বার্থেই মিস হোলিস-কে সব রকম সহযোগিতা করছে। যৌথ উদ্যোগে আজ থেকে তিন বছর আগে ইংল্যান্ডের সব কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, ‘কারও কাছে যদি এই দুর্মূল্য বল থেকে থাকে দয়া করে ফেরত দিন। এই বল শুধু বার্মিংহামের নয়, ইংল্যান্ডের জাতীয় সম্পদ।’ কিন্তু বিজ্ঞাপনে সাড়া মেলেনি।
ফিল ব্রাইট বললেন, “সবচেয়ে সমস্যা হল হোলিস যে ধরনের মানুষ ছিলেন, উনি বলের ওপরে ডনকে সইটই করাননি। নিজেও কোনও ফ্রেমিং করাননি। নিছকই কালচে হয়ে যাওয়া একটা বল। কেউ নিজে ফেরত না দিলে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতোই অসম্ভব।”
কাউন্টি কর্তাদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে মনে হল, ব্র্যাডম্যান বা হোলিস যেমন পরপারে চলে গিয়েছেন, আর কখনও ফিরবেন না, তেমনই বলের আশাও তাঁরা প্রায় ত্যাগ করতে বসেছেন। যদিও শ্রীমতী হোলিসের পীড়াপীড়িতে আরও এক বার মিডিয়ার মাধ্যমে আবেদন জানানো হতে পারে।
মুখে না বললেও সকলেরই ধারণা, লাখ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে বার্মিংহামের ক্লাব থেকে পাচার হয়ে গিয়েছে বলটা। আজও কোথাও না কোথাও সযত্নেই আছে। কিন্তু কখনও প্রকাশ্য হবে না। |
|
|
|
|
|