কসাইখানার নাম এজবাস্টন
জবাস্টনের চারতলার ব্যালকনিতে তাঁকে পেয়ে গেলাম। ব্যালকনি না বলে ছাদও বলা যায়। কমেন্ট্রি বক্সের ঠিক সামনের খোলা জায়গাটা। দু’ধারে ভেসে আসছে জনতার চিৎকার। ভারতীয়দের লক্ষ্য করে বিদ্রুপ। তারই মধ্যে পায়চারি করতে করতে ভদ্রলোক বললেন, “৪-০ হচ্ছে। ওভালটাও হারবে।”
প্রাক্তন অধিনায়ক ইনি। ভারত-ইংল্যান্ড গত সিরিজ এ দেশে জাঁকিয়ে খেলেছেন। নাম আন্দাজ করা খুব সহজ। মাইকেল ভন। ক’দিন ধরেই যিনি টুইট করে যাচ্ছেন ৪-০ হচ্ছে। সমস্যা হল, ইনি মাইকেল ভন নন। ভনের সমসাময়িক বিপক্ষ ভারত অধিনায়কসৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথম দু’টেস্ট হারের চরম নৈরাশ্যের মধ্যে একমাত্র সৌরভ দাঁড়িয়েছিলেন ধোনিদের পাশে। বলেছিলেন, দেখে নেবেন এরাই চাবুকের মতো ফেরত আসবে। শুক্রবারের শেষ বিকেলে দেখলাম তাঁর ক্রিকেটপ্রজ্ঞাও স্ট্রসদের আধিপত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দেখা গেল সৌরভ শুধু আত্মসমর্পণই করেননি, আর বাকিদের মতো গভীর নৈরাশ্যেও ডুবে গিয়েছেন।
ডাবল সেঞ্চুরির পর কুক।-এপি
বার্মিংহামের আবহাওয়াই একমাত্র এখন ঠিক করবে বিশ্বের পয়লা নম্বরের মুকুটটা ইংল্যান্ড শনিবার মাথায় পরবে, না রবিবার। যে দিনই পরুক, ইংল্যান্ডের পয়লা নম্বর হওয়াটা নিছক ঘণ্টার অপেক্ষা। স্ট্রসদের এমনই আধিপত্য যে স্কোরবোর্ডও চরম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। তবু অঙ্কের হিসেব বলে ভারত এখনও ৪৫১ রানে পিছিয়ে। হাতে ন’উইকেট। করণীয় কিছু নেই। তাদের মৃত সাম্রাজ্যের গরিমার জন্য ব্যাট করা ছাড়া। ভারতের একমাত্র এখন পুরু হওয়ার সুযোগ। বিশ্বক্রিকেটের ‘আলেকজান্ডার’ থাকা আর সম্ভব নয়।
সংঘর্ষ আর নিষেধাজ্ঞার ধূসর বাজারে কাল রাত্তিরে ম্যারিয়টস হোটেল থেকে জনাকয়েক ভারতীয় ক্রিকেটারকে বার হতে দেখে অবাক লাগল। ম্যানেজার অনিরুদ্ধ চৌধুরী জানালেন, পরিকল্পিত ভাবেই ওদের হোটেলের বাইরে খেতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে দেহরক্ষী তো থাকছেই। প্লাস আসল আইডিয়া হল, হোটেলের ঘরে গুমরে পড়ে না থেকে বাইরে যাও। ফুরফুরে হয়ে ফেরো। তার পর সেই এনার্জিটা তৃতীয় দিন মাঠে উপুড় করে দাও।
শুনে সেই আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকারী দলগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। যারা মাঠে ফাস্টবোলার বিদ্ধ হয়ে প্র্যাক্টিস কমিয়ে দিত। বলত বার্বেডোজ বা অ্যান্টিগার সি-বিচে যাও। সামুদ্রিক হাওয়ায় মাঠের নৃশংসতা তাড়াও। ফুরফুরে হয়ে পরের দিন মাঠে নামো।
এ হেন সমুদ্রসৈকত প্রেসক্রিপশনে কেমন কাজ হত আলোচনারও দরকার নেই। ক্রিকেট রেকর্ড হাতড়ালেই তা দেখা যাবে। ভারতেরও অনুসৃত বিষ্যুদবার রাতের এজবাস্টন টোটকায় কেমন কাজ হল স্কোরকার্ডে থাকল। অমরত্বের ছোঁয়া সম্দ্ধ একটা স্কোরবোর্ড এজবাস্টন মাঠে রয়েছে। একমাত্র এ মাঠেই রয়েছে। স্কোরবোর্ডের ওপরের ঘড়িটায় বিকেল ছ’টা বেজে দশ। ওয়ারউইকশায়ার চার উইকেটে ৮১০। ব্যাটসম্যান নম্বর তিন অপরাজিত ৫০১। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বকালের সর্বোচ্চ রান। মালিক? কোনও এক ব্রায়ান চার্লস লারা।
অ্যালেস্টার কুক সেই রেকর্ডের হয়তো অনেক দূরে থাকলেন। কিন্তু রানের খিদে, আলগা বল পেলেই নৃশংসতা এবং লম্বা সময় খেলার স্ট্যামিনায় তিনি এজবাস্টনের সতেরো বছর আগের এক টুকরো লারাকে ফেরত এনেছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে এ মাঠে পিটার মে-র ২৮৫ রানের রেকর্ড ভাঙলেন। ট্রিপল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র কয়েক রান দূরে থেমে গেলেও ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচে আজ পর্যন্ত সর্বোচ্চ গ্রাহাম গুচের সেই ৩৩৩ রানের গন্ধ শোঁকা দূরত্বে চলে গিয়েছিলেন। রান-রান করার ভঙ্গি সব ছেড়েই দিলাম। বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানশিপে সামগ্রিক একটা প্রভাব কুক জারি করে দেন। যাতে বলা ছিল এজবাস্টন নিছক কোনও ক্রিকেট মাঠ নয়। কসাইখানা। নিম্নমানের বোলিং এখানে সানন্দে জবাই হয়ে থাকে। কসাইখানার সেই পরিবেশে কেউ বিশ্বাস করবে এই লোকটা গত চার ইনিংসে করেছিল ১২, ১, ২, আর ৫! সিরিজে মোট ২০ রান করা লোকটা সাড়ে বারো ঘণ্টা ধরে ব্যাট করে বিশ্বের পয়লা নম্বরদের ওপর সাতশো রানের বোঝা চাপিয়ে দিল। মাঝেমধ্যে এজবাস্টনের আলোকস্তম্ভে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ছাড়া ইংল্যান্ড চায়নি এমন কিছু তৃতীয় দিনে ঘটেনি।
সকালে তখনও খেলা শুরু হয়নি। নাসের হুসেন জিজ্ঞেস করলেন মাইকেল হোল্ডিংকে। “মাইকি, এই অবস্থায় তুমি থার্ড ডে-তে বল করতে নামছ। টিমের মনোবল বলে কিছু নেই। বিপক্ষ ছ’শো চাপিয়ে দিতে চাইছে। কী ভাবে এগোবে? কী ভাববে?” হোল্ডিং বললেন, “এক্সকিউজ মি নাসের। বলতে পারব না। এমন অভিজ্ঞতায় কখনও পড়তে হয়নি।”
কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়। হোল্ডিং যখন আশির দশকের মাঝামাঝি খেলা ছাড়েন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনও বিশ্বে এক নম্বর। তাদের বা এর পরে যারা বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হল, সেই অস্ট্রেলিয়াকেও এমন অসম্মানজনক হামাগুড়ি দিতে হয়নি। তেন্ডুলকর সমেত ভারতকে শুক্রবারের ইংল্যান্ড সংবাদমাধ্যম যেমন অপমান করল! লিজ হার্লি কাল থেকেই স্কাই টিভি বক্সে ভাষ্যকারদের সঙ্গে ফিচেল আড্ডায় মেতেছিলেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট তিন দিনে নামিয়ে আনলে কেমন হয়? ভারতের সঙ্গে পাঁচ দিন কেন লাগবে? মাইকেল ভন এদিক-ওদিক বলে বেড়ানো শুরু করেন, ভারতের এই টিম বিশ্ব ক্রিকেটের আবর্জনা। এ দিন কোনও কোনও দৈনিক লিখেছে বেদী, প্রসন্ন, কুম্বলের দেশে অমিত মিশ্র হল কী করে, সেটা এই মুহূর্তের সেরা জিজ্ঞাসা। ব্রিটিশ প্রেসের মতে ফিল্ডিং হল ভারতীয়দের জীবনে না এড়াতে পারা পেশাদারি ঝকমারি। সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ‘ডেইলি মেল’। তারা সমারসেটের এক কাল্পনিক কুকুরের কথা লিখেছে। যাকে গৃহকর্ত্রী নিযুক্ত করেছেন এক দল ভেড়াকে লাইন বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কুকুরটা ভেড়ার দলকে এত ভয় পায় যে, কিছুতেই কাজটা করে উঠতে পারে না। তবু ওই কুকুরের মধ্যেও চ্যালেঞ্জকে জয় করার যে মানসিকতা আছে এই ভারতীয় দলের তা-ও নেই। তাদের রাহুল দ্রাবিড়কে যে প্রাচীর বলা হয়, ঠিক বলা হয়। কারণ এই দেওয়ালে লেগে সব সময় ক্যাচ ঠিকরে আসে। এই অবধিও ঠিক ছিল, কিন্তু কাগজটা এরই সঙ্গে একটা হৃষ্টপুষ্ট কুকুরের ছবিও ছেপেছে। ম্যাচ রিপোর্টে কুকুরের ছবি সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম ব্যবহার হল। ভারতীয় দলের ইতিহাসেও প্রচুর বিদেশে হজম করা গঞ্জনা আছে। কিন্তু জন্তুর ছবি ছেপে এমন অপমানের শিকার লর্ডসে সেই ৪২ অলআউটের পরেও হতে হয়নি।
এজবাস্টনের পঁচিশ হাজার দর্শক জমায়েত শুক্রবার সাধারণ ভারতীয়দের বিদ্রুপ করে গেল। ক্রিকেট অদৃষ্টের পরিহাস, বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ভারতকে এক নম্বর করার পিছনে যাঁর অত্যন্ত প্রভাবশালী অংশগ্রহণ সেই বীরেন্দ্র সহবাগ সবচেয়ে বেশি টার্গেট হলেন। একে তো দল ৪৮৬ রানে পিছিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নেমেছে। নিশ্চিত হার সামনে। তার মধ্যে সহবাগ আবার প্রথম বলে আউট। দু’ইনিংসেই প্রথম বলে। মানে ‘কিং পেয়ার’। জীবনে এমন অসম্মান বয়ে আসেনি তার জন্য। কার তখন মনে পড়বে মাত্র ক’মাস আগে বিশ্বকাপে এই লোকটাই প্রতিদিন শুরু করত প্রথম বলে বাউন্ডারি দিয়ে!
আনন্দবাজারের ম্যাচ রিপোর্টের হেডলাইন মেনে নিতে সর্বকালের সেরা টেস্ট টিমে মনোনয়ন পাওয়া ওপেনারের তীব্র সমস্যা থাকতে পারে। তিনি এবং ভারতীয় দলের যন্ত্রণাকাতর অনেকেরই এখন নির্ঘাত মনে হচ্ছে, কসাইখানার নাম এজবাস্টন নয়। এটা একটু নরম।
বধ্যভূমির নাম এজবাস্টন!

ভারত প্রথম ইনিংস: ২২৪
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৪৫৬-৩)

কুক ক রায়না বো ইশান্ত ২৯৪
মর্গ্যান ক সহবাগ বো রায়না ১০৪
বোপারা এলবিডব্লিউ অমিত ৭
প্রায়র ক সচিন বো অমিত ৫
ব্রেসনান ন.আ. ৫৩
অতিরিক্ত ৬৩, মোট ৭১০-৭ ডিঃ। পতন: ১৮৬, ২৫২, ৩৭৪, ৫৯৬, ৬০৫, ৬১৩, ৭১০।
বোলিং: প্রবীণ ৪০-১৩-৯৮-২, শ্রীসন্থ ৩৬-৪-১৫৮-০, ইশান্ত ৩৭.১-৭-১৫৯-১, অমিত ৪৩-২-১৫০-৩,
রায়না ২৮-১-৮৩-১, সচিন ৪-০-১৭-০।

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস

গম্ভীর ব্যাটিং ১৪
সহবাগ ক স্ট্রস বো অ্যান্ডারসন ০
দ্রাবিড় ব্যাটিং ১৮
অতিরিক্ত ৩, মোট ৩৫-১। পতন: ৩।
বোলিং: অ্যান্ডারসন ৫-১-১৮-১, ব্রড ২-০-৭-০, ব্রেসনান ৩-০-৪-০, সোয়ান ১-০-৪-০, পিটারসেন ১-০-১-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.