বৃষ্টি কমেছে, কিন্তু জল ছাড়া কমছে না। বরং মাইথন ও পাঞ্চেতের দৌলতে জল ছাড়া বাড়িয়েই চলেছে ডিভিসি-র দুর্গাপুর ব্যারাজ। নদী উপচে সেই জল ভাসাচ্ছে নতুন নতুন চাষজমি। ধান, সব্জি ও পাট চাষে ক্ষতির পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। জলবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রচুর মানুষও।
ভাগীরথী ও অজয় বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে থাকায় কাটোয়া ও কালনা মহকুমার বহু এলাকা ইতিমধ্যেই জলমগ্ন। প্লাবিত হয়েছে হাজার হাজার বিঘা জমি। শুক্রবার দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ আরও বাড়ায় জামালপুর, মাধবডিহি, খণ্ডঘোষ ও গলসির দামোদর ঘেঁষা নিচু এলাকার মানুষদেরও সতর্ক করা হয়েছে। জমা জলে ইতিমধ্যেই পচতে শুরু করেছে সদ্য লাগানো আমন ধান ও সব্জি।
সকালেই ভাগীরথীর জলোচ্ছ্বাসে কালনা শহরের মহিষমর্দিনী ঘাট-সহ বেশ কয়েকটি ঘাটে কানায় কানায় জল চলে আসে। জল ঢুকে পড়ে শহরের নিচু এলাকায়। কালনা ১ ব্লকের বেশ কয়েকটি পরিবারকে উঁচু জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্লকে এ বার আমন চাষ হয়েছিল ১০,৫৬০ হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টরে চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সব্জিরও। মোট ৫৯০ হেক্টর সব্জি খেতের মধ্যে ৪২০ হেক্টরেই ফলন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
পূর্বস্থলী ১ ব্লকে ক্ষতিগ্রস্ত পঞ্চায়েতের সংখ্যা ৭। সেখানে প্রায় ৭০টি মৌজায় আমন চাষ হয়েছিল ৭,৬৯৬ হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে ১,২০০ হেক্টর ধানজমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। ৯০০ হেক্টর সব্জি খেতের ভিতরে নষ্ট হতে বসেছে ৭০০ হেক্টরেরও বেশি। পূর্বস্থলী ২ ব্লকেও ভাগীরথীর উপচে পড়া জলে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর, ঝাউডাঙা, কাশীপুর, রুদ্রডাঙা, হালতাচরা, মাজিদা, তামাঘাটা, বেতনগর, রাজারচর এলাকায় বহু মানুষ জলবন্দি। প্রশাসনের তরফে বহু পরিবারকে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। |
কিন্তু ত্রাণ নিয়ে শুরু হয়েছে ক্ষোভ। শুক্রবারও বহু মানুষ ত্রাণ চেয়ে পূবর্স্থলী ২ পঞ্চায়েত সমিতিতে বিক্ষোভ দেখান। কালনার মহকুমাশাসক সুমিতা বাগচি জানান, পূর্বস্থলী ২-এর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে এক এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানো হয়েছে। মহকুমায় সবথেকে বেশি সব্জি চাষ হয় ওই ব্লকেই। ৪,১০০ হেক্টর সব্জি খেতের মধ্যে ২,৪০০ হেক্টরে জল ঢুকে গিয়েছে। মন্তেশ্বর ব্লকে পরিস্থতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আমন চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর ধানজমি জলমগ্ন।
কৃষি দফতরের হিসেব অনুযায়ী, কালনায় প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চার হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব্জি চাষ। জেলার সহকারী কৃষি অধিকর্তা নিলয় কর বলেন, “রোদ উঠলেও সব্জি খেতে ভাইরাস সংক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।”
ভাগীরথী ও অজয়ের জল বাড়তে থাকায় কাটোয়া মহকুমায় বিভিন্ন গ্রামে নতুন করে জল ঢুকতে শুরু করেছে। এ দিন পর্যন্ত জলের তলায় গিয়েছে মোট ১৯ হাজার হেক্টর জমি। মহকুমার ৫টি ব্লকের ২৮০টি মৌজায় জল ঢুকে খেতজমি ডুবে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত কাটোয়া ১ ব্লকে ১১০০, কেতুগ্রাম ১ ব্লকে ৪০০০, কেতুগ্রাম ২ ব্লকে ৮০০০ ও মঙ্গলকোটে ৩৫০০ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। |
বৃহস্পতিবার অজয়ের জল না বাড়লেও এ দিন দুপুরে হিংলো বাঁধ ৩ হাজার কিউসেক জল ছাড়ায় তা ফের বেড়েছে। ফলে, ভাগীরথী বিপদসীমাও অতিক্রম করেছে। কাটোয়া শহর সংলগ্ন বাঁধের নিচু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, আরও ১০০টি পরিবার ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এ দিনই চারটি ত্রাণ শিবির খোলা হয়। কাটোয়া শহরে ১০টি ত্রাণশিবিরে বানভাসি মানুষ রয়েছেন। কাটোয়ার মহকুমাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
অজয় ও কুনুর নদীর জলে নতুন করে মঙ্গলকোটের গোতিষ্ঠা পঞ্চায়েতের আওগ্রাম, বালিডাঙা, ভাল্যগ্রামের আঁতাকুল-সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জল উঠে পড়েছে মঙ্গলকোটের নতুনহাট-গুসকরা রাস্তায়। ভাগীরথী ও অজয়ের তীরে থাকা বিভিন্ন ফেরিঘাট ডুবে যাওয়ায় বিপজ্জনক ভাবে নৌকা পারাপার চলছে। বিভিন্ন এলাকায় ভাগীরথীর জল আটকানোর জন্য বালির বস্তা মজুত করেছে কাটোয়া পুরসভা-সহ সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতগুলি। নদীর তীরবর্তী এলাকায় পুরসভা ও পঞ্চায়েত সর্বক্ষণ ‘কন্ট্রোল রুম’ খুলে রেখেছে। ভাগীরথীর জল ঢুকে গিয়েছে কেতুগ্রাম ২ ও কাটোয়া ২ ব্লকের বেশ কয়েকটি জায়গাতেও। কেতুগ্রাম ২ ব্লকের বিভিন্ন রাস্তা জলমগ্ন থাকায় যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি। কুঁয়ে নদীর জল ঢুকে কেতুগ্রাম ১ ব্লকের চেচুরি, চাপটা-সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। |