|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
সুলক্ষণ |
তিন দশকের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাস অনুশীলনের পর আলোচনার টেবিলে আল্ফা কী দাবি-সনদ পেশ করিবে, তাহা লইয়া ঘোরতর জল্পনা ছিল। দেখা গেল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহিত বৈঠকে আল্ফা নেতৃত্ব যে-সব দাবি পেশ করিল, তাহার কোনওটি অর্জন বা আদায়ের জন্যই এত হিংসা ও রক্তপাতের প্রয়োজন ছিল না, আলোচনার মাধ্যমেই মীমাংসা হইতে পারিত। ইহা দুর্ভাগ্যজনক যে, জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদের সন্ত্রাসবাদী অভিযান ও তাহার মোকাবিলা করিতে গিয়া সেনাবাহিনীর জবাবি অভিযান অসমে এতগুলি নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করিয়াছে। আজ যখন আল্ফার দাবি-সনদ হইতে অসমের সার্বভৌমত্বের দাবিটিই বাদ পড়িয়া গেল, তখন এত সমৃহ অপচয়ের তো কোনও আবশ্যকতা ছিল না। অবশিষ্ট যে-সব দাবি আল্ফা করিয়াছে, জনজাতীয় ভূমিপুত্রদের আত্মপরিচয় ও বস্তুগত সম্পদের সুরক্ষা, রাজ্যের খনিজ ও তৈল সম্পদের উপর রয়্যালটি, বেআইনি অনুপ্রবেশ রোধ, শিল্প ও পরিকাঠামোর বিকাশ এবং কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন সেই সব দাবিই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়াই আদায় করা সম্ভব ছিল।
আল্ফা জানিত, সার্বভৌমত্বের দাবি না ছাড়িলে কেন্দ্রের সহিত কোনও আলোচনা সম্ভব নয়। বাকি দাবিগুলি সবই স্বায়ত্তশাসনের দাবি, আত্মশাসনের ক্ষেত্রগুলি সম্প্রসারিত করার দাবি। উত্তর-পূর্বের জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে এই দাবির মোকাবিলা ও মীমাংসা করিতে কেন্দ্র অভ্যস্ত। অঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অসমে যে জনজাতির আত্মপরিচয় আরও বেশি করিয়া খর্ব ও খণ্ডিত হইয়াছে, ইহাতে সংশয় নাই। স্বভাবতই বঞ্চনা, শোষণ ও প্রতারণার শিকার হওয়ার গ্লানি ও অসম্মান অসমিয়াদের মনে দীর্ঘ কাল লালিত হইয়াছে। আল্ফার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদের পটভূমিতে আশির দশকের যে ‘বিদেশি বিতাড়ন’ আন্দোলনের প্রেক্ষিত ছিল, আসু ও অসম গণ পরিষদের সেই তুমুল ছাত্র-আন্দোলনও এই বঞ্চনা ও শোষণকেই প্রচারের হাতিয়ার করিয়াছিল। আলোচনার সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আল্ফা নেতৃত্বকে বলিয়াছেন, আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য আইন, তাই প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করাও দরকার। সাধু। নয়াদিল্লির শাসকরা প্রায়শ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে আত্মশাসন মঞ্জুর করিতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। অন্তত সহজে যে স্বশাসনের দাবি শিরোধার্য করা হয় না, তাহা নিশ্চিত। ফলে অনেক জনজাতীয় আন্দোলনই দীর্ঘ রক্তক্ষয় ও সমূহ মানবিক অপচয়ের শেষে তাহাদের প্রাপ্য অধিকার পাইয়া থাকে। সহানুভূতির সঙ্গে এই সব আন্দোলনকে বিবেচনা করিলে হয়তো প্রাথমিক পর্বেই সংঘর্ষ ও মোকাবিলা এড়াইয়া সহযোগিতা ও উন্নয়নের পথে উড়ান দেওয়া সম্ভব হইত। কিন্তু শাসকের অহমিকা, প্রান্তিকের প্রতি কেন্দ্রের অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য সেখানে অন্তরায় হইয়া ওঠে। শেষ পর্যন্ত প্রান্তকে যেমন কেন্দ্রের কাছে নত হইতে হয়, কেন্দ্রকেও তেমনই প্রান্তের বলিষ্ঠ আত্মঘোষণা শিরোধার্য করিতে হয়। মাঝখান হইতে অনেক নিরীহ প্রাণ নষ্ট হইয়া যায়। অসম আন্দোলনের কম্পমান যবনিকা তাহারই ইঙ্গিত। |
|
|
|
|
|