|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
পৃথক ফল |
পরাধীন এবং অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে ১৮৬১ সাল বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হইবার দাবি রাখে। ওই বছরটিতে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন চার জন বিশিষ্ট বঙ্গসন্তান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার এবং ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। হিসাব অনুযায়ী, এই বছরটিতে তাঁহাদের জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি। দেড়শত বৎসর কালের পদযাত্রার পথে একটি স্মরণীয় মাইলফলক। সেই কারণে ১৮৬১ সালে যাঁহারা জন্মিয়াছিলেন, আজ তাঁহাদের অবদান অবশ্যই বিশেষ ভাবে স্মরণযোগ্য। স্মরণের প্রস্তুতি এবং প্রক্রিয়া চালু রহিয়াছে। কিন্তু এক যাত্রায় কেবল পৃথক ফল মিলিতেছে না, পার্থক্য তথা বৈষম্যের মাত্রাটি রীতিমত দৃষ্টিকটু এবং দুর্ভাগ্যজনক। একই বৎসরে জন্মাইয়াছিলেন যে চার জন, তাঁহাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালির সব চেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। তাঁহার স্মরণ যে সব চেয়ে বেশি হইবে, তাহাও পূর্বানুমিত। ভক্তি-প্রবল এই ভূমিতে ‘বিশ্বকবি’ তথা ‘গুরুদেব’কে নূতন করিয়া বন্দনার জন্য নানারকম পরিকল্পনা লওয়া হইয়াছে, তাহাও অপ্রত্যাশিত নহে। এতদুপলক্ষে দশ কোটি টাকার সরকারি অনুদান যেমন ঘোষিত হইয়াছে, তেমনই আজ তাঁহার মৃত্যুদিবসটিকে ছুটির দিন হিসাবে চিহ্নিত করিতে রাজ্যের পরিবর্তনপন্থী মুখ্যমন্ত্রী তৎপর হইয়াছেন। এবম্বিধ উচ্চরোল উদ্যাপনের ভিড়ে একটি প্রশ্ন কিন্তু থাকিয়াই যায়। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণের অর্থ কি বাকি তিন জনকে বিস্মরণ? নীলরতন এবং ব্রহ্মবান্ধবকে বিশ্বায়নপ্রেমী বাঙালি হয়তো আর চিনেও না, কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্রকেও কি সে ভুলিয়া গিয়াছে? প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মের দেড়শত বর্ষপূর্তি স্মরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে পারিত আগের সরকার, করে নাই। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও তাঁহার প্রতিকৃতিতে একটি মাল্যদান করিয়াই সরকারি কর্তব্য সমাধা করিয়াছেন। দেখা যাইতেছে, এ ব্যাপারে তিনি মোটেই পরিবর্তনপন্থী নহেন। কিন্তু এই অভিযোগ কেবল সরকার বা রাজনীতিকদের সম্পর্কে নহে, বঙ্গীয় সমাজও এই বিস্মৃতির শরিক। এবং অবশ্যই স্বীকার্য যে, এই সংবাদপত্রও তাহা হইতে মুক্ত নহে। ইহা, বস্তুত, এক সার্বিক ব্যাধি। সর্বগ্রাসীও বটে। স্মরণকার্যে রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্রের মধ্যে অপার বৈষম্যের কারণ বুঝিতে কষ্ট হয় না। বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) গ্রন্থে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বলিয়াছিলেন, ‘...বিশুষ্ক জ্ঞানময় অধ্যাত্ম সাধনার স্থান বাঙালী চিত্তে স্বল্প ও শিথিল’, তাহার ধ্যানের দেবতাকে সে সন্ধান করিয়াছে ‘বিশুদ্ধ জ্ঞানের পথে ততটা নয় যতটা রূপের ও রসের পথে..’। কথাটি ব্যাপকতর অর্থে সত্য। মননশীলতার যতগুলি শাখা হইতে পারে, তন্মধ্যে বাঙালির চোখে উত্তমর্ণ হইল কলা। সাহিত্য, নৃত্য, গীত, শিল্প ইত্যাদি। বিজ্ঞান অধমর্ণ শ্রেণিতে পড়ে, সুতরাং তাহার সেবক প্রফুল্লচন্দ্রকে অবজ্ঞা করিলেও চলে। এই মনোভাব শুধু এই বঙ্গদেশে নহে, সমগ্র ভারতবর্ষে বিস্তৃত। ইহা গভীর খেদের বিষয়। যে দেশে একদা আবিষ্কৃত হইয়াছিল শূন্য-এর মতো একটি অত্যাশ্চর্য ধারণা, কিংবা দশমিক পদ্ধতিতে সংখ্যা লিখিবার প্রকরণ, তাহার আজ কী দুর্দশা! কথিত আছে, ইতিহাসকে অবজ্ঞা করিলে পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাঙালি তথা ভারতবাসীরও বোধ হয় ইহাই বিধিলিপি। এ স্থলে এই কথাও বলা জরুরি যে, প্রফুল্লচন্দ্র শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন চিন্তানায়কও। বাঙালির চরিত্রে যে-যে ত্রুটিগুলি সমগ্র জাতিটিকে পশ্চাতে টানিয়া রাখে, তাহার প্রত্যেকটি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই ওই বিজ্ঞানী। আলস্য এবং প্রাচীন চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া কোন পথে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, সেই নির্দেশিকাও স্পষ্ট করিয়া তৈরি করিয়াছিলেন তিনি। তাহা না হইলে গবেষণাগারে বসিয়াও কেন স্থাপন করিলেন শিল্প? সরস্বতীর পাশাপাশি লক্ষ্মীর আরাধনাও যে সমান জরুরি, তাহা একশত বৎসর পূর্বে বুঝিয়াছিলেন ওই চিন্তাবিদ। এ হেন ব্যক্তিত্বকে যথাযথ মর্যাদা দিতে না-পারা শুধু ব্যর্থতা নহে, পাপও বটে। |
|
|
|
|
|