‘ঈশান’কে দেখেই প্রেরণা, নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত মলয়
‘ঈশান নন্দকিশোর অবস্তি’র মুক্তি ছিল রঙে-রেখায়। জীবনযুদ্ধে জিতিয়ে দিতে তার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন এক জন ‘নিকুম্ভ স্যার’।
কিন্তু তাঁর দিকে সে ভাবে হাত বাড়ানোর কেউ ছিল না। বরঞ্চ প্রকৃত রোগ কেউ বুঝে উঠতে না পারায়, বরাদ্দ হয়েছে তিরস্কার, মানসিক রোগের ওষুধ, ঘুমের বড়ি। তিনি, মলয় ঘোষ-ও কিন্তু উত্তীর্ণ হয়েছেন।
সেলুলয়েডের পর্দায় ঈশান যা পেরেছে তুলি ও রঙে, মলয়বাবু বাস্তবের জমিতে সেটাই করে দেখিয়েছেন গান ও সুরে। বরঞ্চ বলা ভাল দুর্লভ এবং হারিয়ে যাওয়া সুরের পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন প্রতিবন্ধকতার ঊর্ধ্বে। এক সময় অভাবের চাপে দিশেহারা মানুষটি আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নষ্ট হয়ে যাওয়া রেকর্ড এবং ক্যাসেটও সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে সংস্কার করে এবং সিডি-তে রূপায়ণ করে এক সফল উদ্যোগপতি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি নিবাসী, বিয়াল্লিশ বছর বয়স্ক মলয়বাবু বলছেন, তিনি ‘ঈশানে’র কাছে ঋণী। কেননা কলেজ জীবনের শুরু থেকেই যে সব সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন তিনি, তার সমাধান তখন করতে পারেননি কোনও ডাক্তার। হাতের লেখা দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছিল। জুতোর ফিতে বাঁধতে পারতেন না।
স্ত্রীর সঙ্গে নিজের বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র
টাই পরতে পারতেন না, পারতেন না আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ক্রিকেট-ফুটবল খেলতে। যে সব স্নায়ুবিশেষজ্ঞরা সে সময় তাঁকে দেখেছেন তাঁদের বেশির ভাগেরই বক্তব্য ছিল, এটা মানসিক সমস্যা। ঘুমের ওষুধ দিয়ে স্নায়ুকে ঠান্ডা
করা ছাড়া নাকি কোনও রাস্তা নেই! অনেক পরে আমির খানের ‘তারে জমিন পর’ ছবিটি দেখার পর চমকে ওঠেন মলয়বাবু। বললেন, “ছবিটি দেখে বুঝতে পারলাম, আমার আসল রোগটি কী। ইশানের ছিল ডিসলেক্সিয়া। আমারও সমগোত্রীয় ডিসগ্রাসিয়া। সমস্ত রোগলক্ষণ হুবহু মিলে গেল। অবশ্য তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।”
অথচ স্কুলে পড়ার সময় সমস্যাটা ততটা বুঝতেই পারেননি সাউথ পয়েন্টের মেধাবী ছাত্র মলয়বাবু। গানের চর্চার সঙ্গে সমান মনোযোগে চালিয়ে গিয়েছেন পড়াশুনো। “কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই শুরু হল সমস্যা” জানাচ্ছেন তিনি। “আমার হাতের লেখা ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে লাগল। লিখতে গেলে প্রবল যন্ত্রণাও হত হাতে।” একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম দু’বছর কোনওক্রমে টানলেও চূড়ান্ত বর্ষে হল ব্যাপক সঙ্কট। তাঁর কথায়, “হাতের লেখা বলে তখন আর প্রায় কিছুই থাকল না। পরীক্ষায় স্কেচ পেন দিয়ে লিখতাম এবং সবশেষে খুব কষ্ট করে খাতার শেষে আমার সমস্যার কথা জানিয়ে আবেদন করতাম, যেন পাশ করিয়ে দেওয়া হয়।” টায়েটুয়ে পাশ তাঁকে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই মার্কশিট নিয়ে প্রতিযোগিতার বাজারে কোথাও সুবিধা করে উঠতে পারলেন না মলয়বাবু। মার্কেটিং-এর কাজেও কোনও সংস্থাই তাঁকে রাখতে চাইত না। কম্পিউটার তখনও আসেনি। তাঁর হাতে লেখা রিপোর্ট বুঝে উঠতে পারত না কেউই।
স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। কিন্তু সেটা চালানোই যখন প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে গেল তখন আশ্রয় নিতে হল ছোটবেলা থেকে শেখা গানেই। “শৈশব থেকেই গানের পরিবেশ ছিল বাড়িতে। আমি নাকি তিন বছর বয়সেই পান্নালালের গান মুখস্থ গাইতে পারতাম! আমার স্ত্রী এক দিন বললেন, এক বার শেষ চেষ্টা করে দেখোই না।” কিন্তু শুধু পুজোয় অনুষ্ঠান করে বা গান শিখিয়ে কত দূর এগোনো যায়? দেওয়ালে যখন পিঠ প্রায় ঠেকে গিয়েছে তখনই এক অভিনব পরিকল্পনা খেলে গেল তাঁর মাথায়। ততক্ষণে দেখে ফেলেছেন ‘তারে জমিন পর’।
নতুন করে জেনেছেন নিজেকে। বেড়ে গিয়েছে আত্মবিশ্বাস। মলয়বাবুর কথায়, “লং প্লেয়িং রেকর্ডের চল উঠে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে অনেক গান। বহু ক্ষেত্রেই কোনও সঙ্গীত সংস্থা নতুন করে সেগুলির সিডি করছে না। অথচ আমার ধারণা তার বাজার এখনও রয়েছে।”
লিখতে পারতেন না। কিন্তু কম্পিউটারের মাউস কিন্তু মলয়বাবুর হাতে কথা বলতে শুরু করল। বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অক্লান্ত যোগাযোগে এবং নিজের ইলেকট্রনিক্স নিয়ে গভীর পড়াশুনোর সুবাদে তৈরি করলেন এমন সফ্টওয়্যার যাতে পুরনো, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত রেকর্ড থেকে সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার করা যায় স্বর। যা শোনাবে একেবারে নতুন রেকর্ডিং-এর মতোই। নিজের সমস্ত সঞ্চয় বাজি রেখে বিদেশ থেকে আনিয়ে নিলেন রেকর্ডপ্লেয়ার। বিজ্ঞাপন দেওয়ার আর টাকা ছিল না। তাঁর স্ত্রী হাতে লিখে দিল্লির সমস্ত বড় শপিং মল অথবা জনবহুল জায়গায় প্ল্যাকার্ড লিখে আসতেন।
এক বছরের মধ্যে তেহরি গাড়ওয়েলের মহারাজা মনুজেন্দ্র শাহ থেকে চিত্তরঞ্জন পার্কের আম বাঙালি সবাই তাঁর ‘ক্লায়েন্ট!! ফৈয়জ খাঁ থেকে কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় সবাই নতুন করে জেগে উঠছেন তাঁর পরিশ্রমে। মূল রেকর্ডের আবেদন অক্ষুণ্ণ রাখতে কভারের ছবি স্ক্যান করে সিডির প্রচ্ছদও করছেন তিনি। এর ফলে যে বিপুল সম্ভার তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় তৈরি হচ্ছে, এ বার তার কপিরাইট পাওয়া নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন মলয়বাবু। কথা বলছেন আইনজীবীদের সঙ্গে।
আর এই প্রবল ব্যস্ততার মধ্যে সম্প্রতি একটি চিঠিও লিখেছেন খোদ আমির খানকে। এখন উত্তরের অপেক্ষায়। কেননা তাঁর ছবিটিই তো মলয়বাবুকে প্রেরণা জুগিয়েছে ঘুরে দাঁড়াতে!
Previous Story Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.