লাল জরির কারুকাজ করা খাকি পোশাক। মাথায় পাগড়ি। তলোয়ার হাতে নিয়ে চোখ বোলাচ্ছেন উপস্থিত জনতার উপরে।
কালনার মহিষমর্দিনী পুজোয় সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত মণ্ডপে গেলেই দেখা মেলে এই রক্ষীর। দেবীর নিজস্ব রক্ষী। গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে এই কাজ করে আসছেন সিংহ পরিবারের সদস্যেরা। বংশের পরম্পরা মেনে এ বার তলোয়ার, পাগড়ি ও পোশাক ছেলের হাতে তুলে দিলেন ৪০ বছর ধরে এই কাজ করে আসা গণেশ সিংহ। গত শুক্রবার, পঞ্চমীর দিন সকালে রক্ষীর সাজ-সরঞ্জাম ছেলে পবন সিংহের হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, “বংশ পরম্পরায় যাতে এই ঐতিহ্য বজায় থাকে, সে দিকে লক্ষ রেখো।”
কালনার বহু বছরের পুরনো উৎসব এই মহিষমর্দিনী পুজো। পঞ্চমীর সকালেই দেবীকে গয়নায় সাজানো হয়। এছাড়াও মণ্ডপে থাকে প্রচুর বাসনপত্র। এক সময়ে এই সবের নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তেছিল সিংহ পরিবারের উপরে। দেবীর নিজস্ব রক্ষী হিসেবে পঞ্চমীর দিন সকাল থেকেই তিনি থাকতে শুরু করেন মণ্ডপে। দশমীর সন্ধ্যায় যখন দেবীমূর্তি নিয়ে আতসবাজি ও নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা হয়, রক্ষী থাকেন দেবীর সামনেই। বিসর্জনের আগে দেবীর গা থেকে গয়না খোলা হয়। তার পরেই শেষ হয় রক্ষীর কাজ। |
সময় বাড়ার সঙ্গে কলেবরে বেড়েছে পুজো। বর্তমানে এই পুজোকে ঘিরে বিভিন্ন জেলা থেকে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয়। নিরাপত্তা জোরদার করতে মোতায়েন করা হয় পুলিশ। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও প্রাচীন রেওয়াজ তুলে দেওয়া হয়নি। পুজোর শুরু থেকেই মাথায় পাগড়ি ও হাতে তলোয়ার নিয়ে হাজির থাকেন সিংহ পরিবারের প্রতিনিধি। গণেশবাবুর থেকে রক্ষীর সাজ-সরঞ্জাম পবনবাবুর হাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও এক পুরুষ বজায় থাকল এই রেওয়াজ।
গণেশবাবু বলেন, “আমার বয়স হয়েছে। শরীর আর ঠিক মতো চলে না। দেবীর নিরাপত্তার দায়িত্ব তাই ছেলের হাতে তুলে দিলাম।” তাঁর দাবি, পাঁচ পুরুষ ধরে তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা দেবীর প্রহরায় নিযুক্ত রয়েছেন। প্রহরা দেওয়ার সময়ে কখনও কোনও বিপদে পড়তে হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেবীর আশীর্বাদে কখনও কোনও অনিষ্ট হয়নি। আশা করি ভবিষ্যত প্রজন্মকেও সমস্যায় পড়তে হবে না।” বছর আঠাশের পবনবাবু ব্যবসার কাজকর্ম দেখেন। তিনি বলেন, “বাবার শরীর ভাল যাচ্ছে না। মাস ছয়েক আগে থেকেই রক্ষী হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করি। দোকানে পোশাক তৈরি করতে দেওয়া হয়।” তাঁর কথায়, “বাবা-ঠাকুরদার মুখে পুজোর অনেক কথা শুনেছি। চেষ্টা করব নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে।”
পুজো কমিটির সভাপতি সুশীল মিশ্র বলেন, “দেবীর নিজস্ব রক্ষীর মতো এমন অনেক পুরনো রেওয়াজ আমরা চালু রাখা হয়েছে।” পুজো কমিটির সদস্য ভরত পালের কথায়, “এক সময়ে দেবীর নিরাপত্তার ব্যাপারে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতেন সিংহ পরিবারের সদস্যেরাই।”
উৎসবের শেষে পুজো কমিটির তরফে রক্ষীকে কিছু টাকা দেওয়া হয়। গণেশবাবু বলেন, “ওই টাকা বলার মতো কিছু নয়। তবে পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রাখতেই এই কাজ করে যেতে চাই আমরা।” |