বুড়ো বট গাছ তলায় মা কালীর মন্দির। জ্বলছে দীপ, ধূপ। মন্দিরের চাতালে পড়ে আছে জয়সিংহের নিথর দেহ। তাঁর বুকে ছুরি। পাশে স্বজন হারানো শোকে বিলাপ করছেন মন্দিরের পুরোহিত এবং অপর্ণা। নেপথ্যে ধ্বনিত হচ্ছে রবি ঠাকুরের গান, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন ওই বাটে’।
এই দৃশ্য দেখে আপ্লুত উপস্থিত সবাই। শেষ হল রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কুশীলবদের কুর্নিশ জানালেন কয়েকশো দর্শক।
শনিবার আসানসোলের রবীন্দ্রভবন মঞ্চে এই নাটক মঞ্চস্থ করলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার ও আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত কয়েক জন বন্দি। আসানসোল বিশেষ সংশোধনাগার ও পুরসভা আয়োজিত অনুষ্ঠানে কয়েকশো দর্শকের সঙ্গে নাটক দেখেন রাজ্যের কারামন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী ও আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। ছিলেন আসানসোলের মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ জেলা ও মহকুমা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও। |
প্রথমটায় অপেশাদার কুশীলবদের কিছুটা যেন অবজ্ঞাই করেছিলেন দর্শকেরা। ভেবেছিলেন কী আর এমন অভিনয় করবেন বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা। কিন্তু নাটকের দৃশ্যান্তর যত হয়েছে ততই বিস্ময় বেড়েছে। আবেগ ধরে রাখতে পারেননি আসানসোলের নাট্যকর্মী অমিত দাস। নাটক শেষে সোজা মঞ্চে হাজির। জড়িয়ে ধরেছেন কুশীলবদের। আপ্লুত কারামন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তীও। মঞ্চে গিয়ে জনে জনে কথা বলেছেন কুশীলবদের সঙ্গে। জেনে নিয়েছেন তাঁদের সমস্যা, চাহিদা ও দুরবস্থার কথা। মাইক হাতে আবেগ মথিত কন্ঠে কথা দিয়েছেন, সব সমস্যা ও চাহিদা পূরণের চেষ্টা তিনি করবেন। প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত কয়েকশো দর্শকের চোখের কোণ ততক্ষণে ভিজে গিয়েছে।
নাটকের পরিচালক তরুণতপন গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ছাত্র। বর্তমানে তিনি সংশোধনাগারের কর্মী। জানালেন, সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের নিয়ে ‘কালচারাল থেরাপি’ শুরু হয়েছে বছর কয়েক আগে। তাঁদের শেখানো হচ্ছে নাচ, গান, ছবি আঁকা। মাস ছ’য়েক আগে এডিজি (কারা) বংশীধর শর্মা তরুণতপনবাবুকে একটি নাটকের দল তৈরি করতে বলেন। রাজি হয়ে যান তিনি। তিনি বলেন, “চার জন মহিলা-সহ ১৯ জনের এই দলটি বানাই প্রেসিডেন্সি ও আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের নিয়ে।” বিভিন্ন সংশোধনাগারের বন্দীদের সামনে তাঁরা এই নাটক মঞ্চস্থ করছেন। তবে, সাধারণ দর্শকদের জন্য এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত দু’টি মঞ্চেই অভিনয় করলেন তাঁরা। প্রথমটি দিন কয়েক আগেই হয়েছে চুঁচুড়ায়। নাটক, যাত্রা, সিনেমায় অভিনয় ও পরিচালনা আগেও করেছেন তরুণতপনবাবু। একটি টেলিফিল্মের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসাবে ২০০২ সালে পেয়েছেন উত্তমকুমার সম্মান। কিন্তু বন্দিদের নিয়ে তৈরি এই নাটকে সব আনন্দ আর সম্মান ছাপিয়ে গিয়েছে বলে তাঁর মত। কী বলছেন কুশীলবেরা? জয়সিংহের চরিত্রে অভিনয় করছেন আকাশ দাস। আগে কখনও নাটকে অভিনয় করেননি। সাজা হয়েছে বছর চারেক। নাটক শেষে তিনি বলেন, “কেমন যেন ফুরিয়ে যাচ্ছিলাম। আবার নতুন করে সব কিছু পেতে ইচ্ছে করছে।” নাটকের চরিত্রে অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় করে খুশি সুজাতা সরকার-ও। তাঁর কথায়, “অতীত নিয়ে আর ভাবি না। এখন যে ভালবাসা পেয়েছি নতুন করে তা আর হারাতে চাই না।”
সমাজের মূল স্রোতে তাঁদের টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন দর্শকেরাও। |