অত কান্না আর্তনাদ শুনেও কারও ঘুম ভাঙল না
মাদের আকুল আর্তনাদ শুনেও কেউ এগিয়ে এল না। এক জনও না!
রাস্তার দু’পাশে খোদ ডিএম আর এসপি’র বাংলো। সেখানে দিন-রাত পাহারা দেন সিপাইরা। তাঁদেরও কারও দেখা মিলল না!
মাটিতে আছড়ে পড়তেই শরীরটা কেমন অবশ হয়ে গিয়েছিল। থুতনি ফেটে গলগলিয়ে রক্ত। কোমর-হাত-পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। সাহায্য চেয়ে আধা-অন্ধকার শুনশান রাস্তায় এ দিক-ওদিক ছুটে প্রাণপণে চিৎকার করে চলেছিলেন আমার স্বামী।
মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিল।
ওই অবস্থাতেই একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ— এখানেই না খুন হয়েছিল রাজীব দাস! সে দিনও তো ওর অসহায় দিদির ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি!
মনে পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে যেন হিম স্রোত নেমে গেল। সাহসের লেশটুকু মুহূর্তে উধাও। এমন ভয় আগে কখনও পাইনি। পাবই বা কেন? আমার স্বামী তপন চট্টোপাধ্যায় যে নিজেই পুলিশ অফিসার! চোর-বাটপাড়েরা আমার আশপাশে ঘেঁষতেই তো ডরাবে! সেই মহা ভুল ভেঙে গেল মঙ্গলবার রাতে। শাশুড়ি ক্যানসারে আক্রান্ত। বারাসত হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালের কাছেই আমার ননদ কবিতার বাড়ি, সেখানে উনি রয়েছেন। জরুরি ওষুধপত্র কিনে দিয়ে ওখান থেকেই বাড়ি ফিরছিলাম। আমি, আমার স্বামী আর মেয়ে নিবেদিতা। রাত তখন সওয়া দশটার আশপাশে।
আমি বসেছিলাম ভ্যানরিকশার সামনে, ডান দিকে। পাশে মেয়ে। উনি (তপনবাবু) ছিলেন পিছনে। হাতের ব্যাগটা কোলে ফেলে রেখেছিলাম। অভ্যেসমতো ব্যাগের দু’টো লম্বা হাতল ডান হাতে দু’তিনটে পাকে জড়িয়ে ধরা ছিল।
ব্যাগে ছিল কিছু টাকা, দু’টো ফ্ল্যাটের চাবি, টুকিটাকি ক’টা গয়না। শাশুড়ির অসুখের জন্য এমনিতেই মনটা ভাল নেই। চোখ বুজে প্রার্থনা করছিলাম, উনি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কাছারি ময়দানের কাছাকাছি এসে চোখ খুলে খেয়াল করলাম, আধো অন্ধকার রাস্তাটা একেবারে নির্জন। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছিল। ভ্যানরিকশা তখন ডিএম-এসপি’র বাংলো পেরিয়ে যাচ্ছে। আশপাশে সরকারের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস। ফের চোখ বুজলাম।
ক’মিনিট যেতে না-যেতেই কেমন একটা অস্বস্তির অনুভূতি! কেউ যেন গলার হার আর হাতের ব্যাগটা ধরে আলতো ভাবে টানছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, মেয়েই হবে। কিন্তু টান বাড়তেই চোখ খুলতে হল। দেখি, আমার পাশে পাশে খুব আস্তে আস্তে চলছে একটা মোটরসাইকেল। তাতে বসে বছর পঁচিশ-তিরিশের দু’টো ছেলে। যে চালাচ্ছে, তার এক হাতে মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে, অন্য হাত আমার গলার হারে। পিছনে বসা ছেলেটার হাত আমার কোলের ব্যাগে! দু’টো হাতই আস্তে আস্তে টান দিচ্ছে।
কারা ওরা?
অঞ্জলিদেবীর পাশে স্বামী তপন চট্টোপাধ্যায়। বুধবার।
বারাসতে আমার অনেক আত্মীয়। তাঁদের ক’জনের ছেলেও ওই বয়সী। আমার চোখে চশমা ছিল না, তার উপরে অন্ধকার। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম, পরিচিত কেউই হবে, মজা করছে। কপট ধমকও দিতাম হয়তো। কিন্তু আচমকা সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল!
হ্যাঁচকা টানে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল ওরা। আর টাল সামলাতে না-পেরে ভ্যানরিকশা থেকে প্রায় ডিগবাজি খেয়ে পিচরাস্তায় সপাটে আছড়ে পড়লাম আমি। ঠোঁটের তলা থেকে চোয়াল পর্যন্ত ফেটে গেল। রক্ত বেরোতে লাগল গলগল করে। হাতের তালু, পায়েরও অনেকটা ছড়ে গেল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বুক থেকে কোমর যেন অসাড়। পড়ে থাকতেই থাকতেই টের পেলাম, অচেনা ছেলে দুটো মোটরসাইকেল থামিয়ে আমার ব্যাগ ধরে টানাটানি করছে!
ইতিমধ্যে ভ্যানরিকশা একটু এগিয়ে গিয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, মেয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে। আর আমার স্বামী ও ভ্যানচালক চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে আসছেন। ওঁদের দেখে ছেলে দু’টো মোটরসাইকেলে উঠে পালাল। উনি (তপনবাবু) ‘চোর, চোর’ বলে চিৎকার করতে করতে পিছনে ধাওয়া করলেন।
কিন্তু মোটরসাইকেলের সঙ্গে কি কেউ ছুটে পারে?
উনিও পারেননি। সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। বরং জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের বাসভবনের নাকের ডগায় এমন ঘটনা ঘটাটাই আশ্চর্যের। আরও আশ্চর্য, ওই সুনসান রাতে আমার গলা ফাটানো আর্তনাদ, স্বামীর চিৎকার, মেয়ের কান্না কোনও কিছুতেই কারও ‘ঘুম’ ভাঙল না! পুলিশের গাড়ির দেখা পাওয়া তো দূর, জেলাশাসক-পুলিশকর্তাদের বাংলোর এক জন সেন্ট্রিও বাইরে এলেন না! অথচ রাত তখন সাড়ে দশটাও গড়ায়নি!
আকস্মিকতা, যন্ত্রণা, আতঙ্কে আমি ততক্ষণে প্রায় বেহুঁশ। ওই ভ্যানরিকশাতেই আমাকে কোনও মতে স্টেশনের কাছে নিয়ে আসা হল। ওখানে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে গেলেন। তাঁরাই আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। খবর পেয়ে গভীর রাতে পুলিশ এল আমার ন’পাড়া কালীবাড়ি রোডের বাড়িতে।
মাস ছয়েক আগের ঘটনাটাই এখন বারবার মনে পড়ছে। ওই রাস্তাতেই তো ছোটভাইকে মদ্যপ ইভটিজারদের ছুরিতে খুন হতে দেখেছিলেন রিঙ্কু দাস। আকুল হয়ে পুলিশকে ডেকেছিলেন। মাথা কুটেছিলেন বাংলোর দরজায়। কেউ এগিয়ে যায়নি।
আমাদের ডাকেও কেউ সাড়া দিল না! একই জায়গায়!


(বুধবার সকালে অঞ্জলিদেবী যখন আনন্দবাজারের জন্য এটি লেখেন, তাঁর শাশুড়ি বাসন্তীদেবী তখনও জীবিত।)

ছবি: সুদীপ ঘোষ
Previous Story South
Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.