রাজীব দাসের বধ্যভূমি ফের দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল
৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ অগস্ট। ১৬৯ দিনের ব্যবধান।
আর এরই অবসরে বারাসতের কাছারি ময়দানে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের বাংলোর সামনের রাস্তায় ফিরে এসেছে সেই একই রকম নৈরাজ্যের অন্ধকার!
ফেব্রুয়ারির ওই রাতে ওই রাস্তায় দিদি রিঙ্কুর শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাস। মদ্যপের দল ভাইকে মারছে দেখে পুলিশকর্তা ও জেলাশাসকের বাংলোর সামনে ছুটে গিয়েছিলেন রিঙ্কু। মাথা কুটেছিলেন বাংলোর ফটকে। কিন্তু সাহায্যের হাত এগিয়ে আসেনি। অসহায় কিশোরটিকে পিটিয়ে-কুপিয়ে মেরে আততায়ীরা নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দেয়।
এর পরে সর্বস্তরের মানুষ ধিক্কার দিয়েছিলেন প্রশাসনকে। চাপে পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও রাজীব-রিঙ্কুর বাড়িতে ছুটে যেতে হয়েছিল। কাছারি ময়দানে রাতে পুলিশও মোতায়েন হয়েছিল।
কিন্তু প্রতিবাদের ঝাঁঝ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে এসেছে। সেই মওকায় বারাসতের ওই তল্লাট যে নিজের ‘সাবেক’ চেহারায় ফিরতে দেরি করেনি, মঙ্গলবার রাতে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অঞ্জলি চট্টোপাধ্যায়ের উপরে হামলার ঘটনা। আর কি আশ্চর্য সমাপতন! আক্রান্ত স্ত্রী রক্তাক্ত অবস্থায় আর্তনাদ করছেন, সাহায্যের আশায় চিৎকার করে ছোটাছুটি করেছেন স্বামী, হাউহাউ করে কাঁদছে মেয়ে এবং এ ক্ষেত্রেও ডিএম-এসপি-এএসপি’র বাংলোর চৌহদ্দি থেকে নড়লেন না রক্ষীরা। ঘটনাচক্রে, অঞ্জলিদেবীর স্বামী তপন চট্টোপাধ্যায় নিজেও পুলিশকর্মী (স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ)। আপাতত যিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুর নিরাপত্তার দায়িত্বে।
কাছারি ময়দান ও লাগোয়া অঞ্চলটি বারাসতের সবচেয়ে সুরক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। কারণ, এখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বারাসত আদালত, জেলাশাসকের অফিস, জেলা পরিষদের অফিস-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোও। পুলিশ-সূত্রের খবর: নিরাপত্তা ও গুরুত্বের প্রেক্ষিতে ওখানে এমনিতেই বছরভর ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকে। রাজীব-হত্যার পরে রাতে পুলিশ-প্রহরাও থাকার কথা। তা ছিল কি?
এখানেই আক্রান্ত হন অঞ্জলিদেবী। কাছারি ময়দানে জেলাশাসকের বাংলো সংলগ্ন এলাকা। —নিজস্ব চিত্র
তপনবাবু জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার রাতে তিনি একাই মোটরবাইক-আরোহী ছিনতাইবাজদের পিছনে ধাওয়া করেছিলেন ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করতে করতে। কোনও পুলিশ দেখতে পাননি। কিন্তু রাজীব-খুনের পরে বারাসত স্টেশন ও আশপাশে নিয়মিত টহলদারির উদ্দেশ্যে যে পাঁচটা পুলিশ ক্যাম্প খোলা হয়েছিল, মঙ্গলবার রাতে সেখানকার পুলিশকর্মীরা কোথায় ছিলেন?
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরে ক’দিন পুলিশ পাহারা দিয়েছে। তার পরে সচরাচর তাদের দেখা মেলে না। পাশাপাশি সমাজবিরোধীদের ‘নৈশ আসরের’ ভূমিকা নেওয়ার অভিযোগে কাছারি ময়দানের যে দোকানগুলোকে ফেব্রুয়ারিতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও ফের গজিয়ে উঠেছে। চত্বরে কয়েকটা আলো লাগানো হলেও একটা দিক আঁধারে ডুবে থাকে। রাত বাড়তে না-বাড়তেই সেখানে নেশাখোরদের আনাগোনা শুরু হয়। রমরমিয়ে চোলাইয়ের ঠেক চলে ঠিক আগের মতোই। বুধবার তপনবাবুর কথায়, “গুন্ডা-বদমাইশ বাদ দিন। কাল রাতে বাড়ি ফেরার জন্য প্রথম যে ভ্যানরিকশাটায় উঠেছিলাম, তার চালকই দেখলাম বেহেড মাতাল! অন্য ভ্যান ধরলাম।”
অর্থাৎ কাছারি ময়দান দিব্যি তার পুরনো চেহারাতেই ফিরে এসেছে। প্রশাসনও যথারীতি উদাসীন। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় মানুষের শ্লেষ, “এত ছোট একটা জায়গা, অথচ তার কোনও নিরাপত্তা নেই! পুলিশ তা হলে সাফ বলে দিক, সন্ধের পরে ও দিকে যাবেন না!”
পলিশ কী বলছে? অঞ্জলিদেবীরা সাহায্য পেলেন না কেন?
পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবারই রাত আটটা নাগাদ বারাসত স্টেশন লাগোয়া এক বাড়িতে ডাকাতি হয়। গোয়েন্দারা সেখানে কুকুর নিয়ে তদন্তে গিয়েছিলেন। তাঁরা যখন সেখানে ব্যস্ত, তখনই কাছারি ময়দানে ছিনতাইবাজেরা হানা দেয় বলে পুলিশ-সূত্রের বক্তব্য। কিছু খোয়া না-গেলেও ছিনতাইবাজদের হামলায় গুরুতর জখম হয়েছেন অঞ্জলিদেবী। এমনকী, ঘটনার প্রায় ৪৫ মিনিট পরে, রাত এগারোটা নাগাদও ওই তল্লাটে কোনও পুলিশের দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ। পরে, রাত একটা নাগাদ অবশ্য পুলিশের টনক নড়ে। শুরু হয় তল্লাশি।
কোথায়, কখন, কী ভাবে... ক্লিক করতে হবে
রাতে অঞ্জলিদেবীকে একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তারেরা তাঁর চোয়ালে তিনটে সেলাই করেন। তাঁকে নার্সিংহোমে ভর্তি করার পরামর্শও দেন। তপনবাবু বলেন, “ডাক্তার বললেও অঞ্জলি এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, ওকে কিছুতেই নার্সিংহোমে রাখা গেল না। বাধ্য হয়ে বাড়ি নিয়ে আসি।”
এ দিকে এ দিন দুপুর তিনটে নাগাদ মারা যান তপনবাবুর মা ক্যানসার-আক্রান্ত বাসন্তীদেবী, যাঁকে দেখে মঙ্গলবার রাতে বাড়ি ফিরছিলেন তপনবাবুরা। বিহ্বল তপনবাবু বিকেলে বলেন, “প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম, রাতের ঘটনার কথা মা যাতে জানতে না পারেন। কিন্তু কোনও ভাবে জেনে গিয়েছিলেন।” বাসন্তীদেবীর মৃত্যু প্রসঙ্গে বারাসত হাসপাতালের সুপার পুষ্পেন্দু সেনগুপ্ত বলেন, “উনি তো খুবই অসুস্থ ছিলেন। এমন অবস্থায় মর্মান্তিক খবর পেলে হার্টফেল করাটা অস্বাভাবিক নয়।” বাড়ির লোকেরও আক্ষেপ, “ঘটনাটি শুনেই উনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পরে মারা যান। এটা না-হলে হয়ত আর কিছু দিন বাঁচতেন!”
কাছারি ময়দান এলাকায় নিরাপত্তার গাফিলতি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের এত অভিযোগ সম্পর্কে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য অবশ্য এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। শুধু জানিয়েছেন, দুষ্কৃতীদের খোঁজে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। জেলাশাসক বিনোদকুমার বলেন, “ব্যাপারটা শুনেছি। পুলিশকে বলেছি বিস্তারিত তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে।”
রাজীব দাসের দিদি সেই রিঙ্কু কী বলছেন?
অঞ্জলিদেবীর উপরে আক্রমণের ঘটনা সম্পর্কে রিঙ্কুর প্রথম প্রতিক্রিয়া, “তা হলে কীসের পরিবর্তন হল? তপনবাবু বাধা দিতে গেলে ওঁরও অবস্থা হয়তো ভাইয়ের মতোই হতো!” এ দিন দুপুরে বাড়িতে বসে রিঙ্কু এর পরে স্বগতোক্তির মতো বলেন, “আলো লাগানোর কথা হল, পুলিশ মোতায়েনের কথা হল, কোথায় গেল সে সব? আর ক’টা রাজীব খুন হলে ঘুম ভাঙবে পুলিশের!”
First Page South
Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.