প্রবন্ধ ...
রয়াল সোসাইটি তাঁকে ‘ভুল’ বলে নাকচ করেছিল
হিগ্স বোসন নিয়ে উত্তেজনা চরমে গিয়ে পৌঁছচ্ছে ইদানীং। হিগ্স বোসন আদৌ আছে কি? হিগ্স বোসন না থাকলে পদার্থবিদ্যার সোনার কেল্লা রাতারাতি ধূলিসাৎ যে কেল্লা মানুষ যুগ যুগ ধরে অতি যত্নে, প্রচণ্ড পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছে। যদি না থাকে হিগ্স কণা, তা হলে ব্রহ্মাণ্ড এক নতুন রূপে আবির্ভূত হবে।
কিন্তু যাঁরা উত্তেজনায় ছটফট করে ‘হিগ্স এসেছে, হিগ্স পেয়েছি’ বলে উঁচু গলায় চেঁচামেচি করছেন, তাঁরা ‘অত্যন্ত ভুল’ এটাই জেনিভা শহরের অদূরে বিখ্যাত কণা-গবেষণা কেন্দ্র ‘সার্ন’-এর ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক রলফ্ হইয়ার-এর অভিমত। কিছু দিন আগেই ফরাসি দেশের গ্রেনোব্ল শহরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বৈজ্ঞানিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি সাধারণ ইঙ্গিতকে কণা ভেবে বসা খুবই মারাত্মক ভুল হবে। ঠিক বলেছেন রলফ্। লার্জ হেড্রন কোলাইডার বা এল এইচ সি যন্ত্রে যে কোনও গবেষণা এক নতুন জগতের দুয়ার খুলবে, সেটা আমরা সবাই জানি। আমাদের এই কলকাতার বিজ্ঞানীদের তৈরি ‘এলিস’ নামে ডিটেকটরের দুটি বিশেষ সংগ্রাহক যন্ত্র থেকে যে সব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তা সত্যই অভাবনীয়, চরম নতুন। তবে, রলফ্ বলছেন, ধৈর্য ধরুন, প্রকৃতির সত্য ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আর সত্যকে তখনই সত্য বলা যাবে, যখন সব সন্দেহ দূর হবে।
এ মাসে মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউটে আর একটি খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। আমার সৌভাগ্য, রলফ্ হইয়ার যখন সেখানে তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন, সেই অধিবেশনটিতে আমাকেই সভাপতিত্ব করতে বলা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন আমার ব্যক্তিগত উত্তেজনা বিজ্ঞানের দৌলতে একেবারে তুঙ্গে। মুম্বইতে হিগ্স-এর ‘এসপার-ওসপার’ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কিন্তু তা হবে না।
উৎসাহী বিজ্ঞানী হিসেবে আমারই যদি এমন অবস্থা হয়, তবে ভেবে দেখুন বৃদ্ধ পিটার হিগ্স-এর কী অবস্থা! যে কণাটির সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত, তা আছে না নেই, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলতে চলেছে। বিজ্ঞানের জগতে এমনটাই হয়। বিরাট সত্যের যাঁরা তপস্বী, তাঁদের উঁচু মাপের ঝক্কি পোহাতে হয়। নেহাতই সঙ্গী-হীন, একাকী অবস্থায়।
১৯৬৪ সালে হিগ্স বোসন-এর তথ্য জগতের সামনে তুলে ধরেছিলেন সে সময়ের তরুণ বৈজ্ঞানিক হিগ্স। তৎক্ষণাৎ বিরাট আলোড়ন উঠেছিল। রলফ্-এর মতে, ২০১২-র শেষ অবধি হয়তো অপেক্ষা করতে হবে হিগ্স বোসন কণা-র অস্তিত্ব আছে না নেই, তা জানার জন্য।
পিছিয়ে যাওয়া যাক প্রায় এক শতাব্দী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২০ সাল, অবিভক্ত বাংলা। তিরিশ বছরের এক সুদর্শন যুবক অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছেন। নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সে যুবকের দৃষ্টিতে প্রতিভার তীক্ষ্ন ছাপ, আর তার সঙ্গে এক উদাসী চাহনি, ভারী চশমার আড়াল থেকে যা বোঝা মুশকিল।
তরুণ, এক দিকে অঙ্কে পারদর্শী, আবার পদার্থবিদ্যার নতুন আবিষ্কারের রোমাঞ্চে মশগুল। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সবে উন্মেষ হয়েছে ইউরোপে, লুই ডি ব্রগলি, মৌলিক কণার একাধারে তরঙ্গ এবং কণার পরিচিতি আবিষ্কার করে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্বের মই বেয়ে বিকিরণের বিচিত্র কোয়ান্টাম ব্যবহার আবিষ্কার করেছেন। সে খবর ইউরোপ থেকে পৌঁছে গিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক নিভৃত কোণে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লর্ড রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীতে নাম কিনেছেন। আরউইন শ্রোডিংগার, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, ম্যাক্স বর্ন, হোলফগাঙ পাউলি, জর্জ গ্যামো নতুন নতুন কথা বলে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। কোপেনহাগেনে নিলস বোর প্রায় গুরুর মতো সভা আলো করে রয়েছেন। ইয়োরোপে পদার্থবিদ্যার গবেষণা এগোচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। উত্তেজনায় রাত্রে কারও ঘুম নেই।
১৯১৬ সালের জেনারাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’র জগৎমাতানো আবিষ্কারের ঝুলি, যার সৃষ্টিকর্তা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। বন্ধুবর মেঘনাদ সাহার মতো সত্যেন্দ্রনাথ বসু রিলেটিভিটি জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করে ছাপিয়েছিলেন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়, সে খবর হয়তো সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে আইনস্টাইনের গোচরে এসেছিল।
পদার্থবিদ্যার জগতে নয়া বিদ্রোহের দামামা, ক্ল্যাসিকাল থেকে কোয়ান্টাম-এ উত্তরণ, ১৯২৪ সালের ঢাকায় তরুণ সত্যেন্দ্রনাথের মাথায় স্বপ্ন জাগিয়েছিল। “প্ল্যাঙ্ক-এর বিকিরণ তত্ত্ব আমি আবিষ্কার করব কেবলই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভর করে, আইজাক নিউটন-এর ধ্রুপদী চিন্তা কাজে লাগিয়ে নয়,” ভেবেছিলেন তিনি। সে কালে এটা খুবই জবরদস্ত অভিপ্রায়। মনে রাখবেন, সেটা ঢাকায় বসে ১৯২৪ সালে, ইংরেজদের দখলগ্রস্ত সাম্রাজ্যের এক নিভৃত কোণে। না আছে টেলিফোন, না আছে ইন্টারনেট, না আছে কোনও যাতায়াত, আছে খালি পোস্ট অফিস, আর নিজের মেধা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়োরি অব রেডিয়েশন বিষয়ক একটি লেকচারে সত্যেন্দ্রনাথ ছাত্রদের বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, তখনকার প্রচলিত তত্ত্ব ভুল, কারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এই তত্ত্ব টেকে না, পরীক্ষার ফলাফল অন্য কথা বলে। নবীন সত্যেন্দ্রনাথ নাকি ভুল করেছিলেন অঙ্কে, কিন্তু পৃথিবীর সেরা অঙ্কবিদের সেই ‘ভুল’-এর মাধ্যমেই প্ল্যাঙ্ক-এর নিয়ম প্রমাণিত হল। এক নতুন প্রবন্ধ বেরিয়ে এল। ‘প্ল্যাঙ্ক’স ল অ্যান্ড হাইপোথেসিস অব লাইট কোয়ান্টা’। এক ঘায়ে একেবারে অভিনব নতুন অধ্যায়।

তথাকথিত ভুলটা কিন্তু খুবই বিচিত্র ব্যাপার। সাধারণ বুদ্ধিতে অধিকাংশ সময়ে সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব ঠিক নয়। সত্যেন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিলেন সাধারণ বুদ্ধির বাইরে। বুঝেছিলেন, সাধারণ ভাবনার সঙ্গে কোয়ান্টাম-এর জগৎ মেলে না। এই হিসেবে, অন্যেরা যাকে মনে করেছিলেন ভুল, সেটাই আসলে ঠিক। হায়, সত্যেন্দ্রনাথের মতো দূরদৃষ্টি ক’জনের থাকে! ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি সোজাসুুজি তাঁর প্রবন্ধ নাকচ করে দিল। কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্স-এর সৃষ্টিকর্তা বিমর্ষ হলেন। বুঝলেন, সাবেকি বিজ্ঞান, বিশেষত পদার্থবিদ্যা, অনেক পিছিয়ে ওঁর ধ্যানধারণার প্রেক্ষিতে।
সত্যেন্দ্রনাথের ‘ভুল’টাই কিন্তু দেখিয়ে দিল কোয়ান্টামের নিয়ম মানলে প্ল্যাঙ্ক-এর বিকিরণ তত্ত্ব সোজাসুজি বেরিয়ে আসে। কেন আসে? কারণ, আলোর কণাগুলো একটা থেকে আর একটা কোনও ভাবেই পৃথক নয়। তা ছাড়া, দু’টি আলো-কণা একই শক্তির। ও-দুটিকে কোনও ভাবেই আলাদা বলতে পারব না। মজার কথা, বিশ্বজগতে আলোর কণাগুলি কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের অনুমান মাফিকই আচরণ করে। পুরনো ধ্যানধারণা থেকে কোয়ান্টামের জগতে প্রবেশ আপন প্রতিভার প্রদীপখানি সম্বল করে। প্রবন্ধটি সযত্নে যথোচিত সম্মাননীয় সম্বোধন জানিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে পাঠালেন। জহুরি জহর চেনে। আইনস্টাইন তখনই বুঝলেন সারমর্ম। বোসের ‘ভুল’ই হল বিশ্ববিখ্যাত ‘বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স’।
যে সব মৌলিক কণা এই সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে, যেমন আলোর কণা, তাদের নামকরণ হল বোসন। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে বোসন চিরকালের জন্য অধিষ্ঠিত হল। মৌলিক কণাগুলির কোন লক্ষণ থাকলে তারা বোসন হবে? সেই লক্ষণটিকে বলা হয় ‘স্পিন’। যেটা একটি মৌলিক কোয়ান্টাম লক্ষণ। আলোর স্পিন এক। আবার যদি কোনও কণার স্পিন শূন্য হয়, তারাও হবে বোসন। যেমন ধরুন, হিগস বোসন।
ব্রহ্মাণ্ডের চার দিকে ব্যাপ্ত আলো, আর তার বিকিরণের মূলে যে কণারা, তারা সবাই বোসন। এই বিরাট আবিষ্কারের ছটায় অনায়াসেই বলা যেতে পারে, ‘ভুবন দোলে বোসন সমুদ্রে’।
সত্যেন্দ্রনাথ এক ধাক্কায় দু’টি বিরাট মাপের আবিষ্কার করলেন। প্রথম হল স্পিন। আর দ্বিতীয়, বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স।
২০০১ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় পদার্থের এমন এক দশা পরীক্ষাগারে তৈরি করার জন্য, যা ওই বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স মেনে চলে। তার বহু কাল আগেই স্পিন আবিষ্কারের জন্য নোবেল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র M Sc! ১৯৫৪ সালে পদ্মবিভূষণ, ১৯৫৮ সালে ৬৪ বছর বয়সে পল ডিরাক-এর প্রচেষ্টায় FRS হন। নিজেকে প্রচার করা তাঁর একেবারেই ধাতে ছিল না। ‘আবিষ্কারটাই তো আসল কথা রে’ ঈশ্বর মিল লেনের বসতবাড়িতে বসে সস্নেহে বলেছিলেন তিনি। বহু কাল আগে, আমরা তখন পড়তুম তাঁর বাড়ির পাশের স্কুলে।
প্রতিভার ছটা, আবিষ্কারের যে তেজ, তার উষা অস্তের লগ্ন বলে কিছু নেই। বোসনের বিচিত্র লীলা আবার সাড়ম্বরে জেগে উঠেছে। এইটেই আমার এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য।
১৯৭৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মৃত্যু। ঠিক এক বছর আগেই (১৯৭৩ সালে) সার্ন-এ এক বিচিত্র আবিষ্কার। কী? নিউট্রাল কারেন্ট, যার কোনও চার্জ নেই। কী এই নিউট্রাল কারেন্ট?
লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের আবদুস সালাম, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিভেন ওয়াইনবার্গ আর সেলডন গ্লাসো তিন জনে একত্রে, আবার কিছুটা একা একাও, গবেষণা করে প্রমাণ করেছিলেন যে, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল এবং তেজস্ক্রিয়তার মূলে ক্রিয়াশীল মৃদু বল এ দুটো আসলে একই জিনিস। অর্থাৎ, ওই দুটো বল’কে তিন বিজ্ঞানী এক যোগসূত্রে বেঁধে ফেলেছিলেন। সেই বেঁধে ফেলারই উপহার নিউট্রাল কারেন্ট। এমন তড়িৎপ্রবাহ, যার কোনও চার্জ নেই। এ হেন নিউট্রাল কারেন্ট বহন করে যে কণারা, তাদের নাম W এবং Z বোসন। অর্থাৎ, এরা সেই সত্যেন্দ্রনাথের কল্পিত কণা। তড়িৎ-চুম্বকীয় এবং মৃদু বলকে যোগসূত্রে বেঁধে ফেলার জন্য সালাম, ওয়াইনবার্গ এবং গ্ল্যাসো নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে। এর চার বছর পরে ১৯৮৩ সালে সার্ন গবেষণাগারে বন্ধুবর কার্লো রুবিয়া এবং ভ্যান ডার মেয়ার শনাক্ত করেন W এবং Z বোসন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দু’জনে পান নোবেল পুরস্কার। অর্থাৎ, সত্যেন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত কণা আবিষ্কারের জন্য পাঁচ-পাঁচটি নোবেল প্রাইজ। প্রাইজ দিতেই হত, কারণ এগুলি ছিল যুগান্তকারী আবিষ্কার। অতীতকে ভেঙেচুরে নতুনকে প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহী, আবিষ্কার। সার্ন গবেষণাগারে যে দিন প্রথম পা ফেলি, সে দিন এক নতুন প্রেরণা পেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম, এখানে, ঠিক এখানেই, আমাদের সত্যেন্দ্রনাথের অনুমান বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ক্রিয়াশীল মোট চারটি বল। তড়িৎ-চুম্বকীয়, মৃদু বলের পাশাপাশি রয়েছে দৃঢ় বল (যা কাজ করে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে) এবং মাধ্যাকর্ষণ। এর মধ্যে তড়িৎ-চুম্বকীয় এবং মৃদু বলকে যোগসূত্রে বাঁধা হয়ে গেছে। ওই একত্রিত বল হল ইলেকট্রো-উইক ফোর্স। বলা যেতে পারে, ফোর্স তিন রকম। দৃঢ়, ইলেকট্রো-উইক এবং মাধ্যাকর্ষণ। এই তিন বলের সমন্বয়সাধন কি সম্ভব? বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, তেমন সমন্বয় সম্ভব। সেই মেলবন্ধনের কাজকে বলা হচ্ছে গ্র্যান্ড ইউনিফেকেশন। তড়িৎ-চুম্বকীয় ও মাধ্যাকর্ষণকে মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন আইনস্টাইন। পারেননি। যদি কখনও সম্ভব হয় গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন, তা হলে W এবং Z বোসন শনাক্তকরণের সাফল্য চিহ্নিত হবে এক মহা উদ্যোগের সোপান রূপে।

W এবং Z বোসন আবিষ্কারের আগে থেকেই হিগস বোসন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। কী এই হিগস বোসন, যার আর এক নাম ‘ঈশ্বর কণা’? অধ্যাপক পিটার হিগস এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। স্কটল্যান্ডে তাঁর বাড়ি। বয়স্ক কিন্তু কর্মঠ। ইনি বেশ কিছু কাল আগে (হিগস বোসন যদিও পরে নামকরণ হয়) অঙ্ক কষে দেখালেন যে, প্রকৃতির সাধারণ ধর্মের যে থিয়োরির নাম হল স্ট্যান্ডার্ড মডেল, তার এক লক্ষণই হল একটি বলের (ফিল্ড অব ফোর্স) আবির্ভাব। যার নাম হিগস ফিল্ড। আর এই বল আদানপ্রদান করে যে কণাটি, তার নাম হিগস বোসন। যত দূর জানি, ইতিহাসে এই দ্বিতীয় বার জীবিত মানুষের নামে একটি কণার নাম হল। প্রথম হল বোসন আর তার পরেই হিগস বোসন। দুটি এক হয়ে এখন বিজ্ঞানের মধ্যমণি। হিগস বোসন-এর ধর্মই হল এই যে, প্রত্যেক মৌলিক কণার ভর বা সোজা ভাষায় ওজন হিগ্স-এর জন্যই। কাজেই, কল্পনার ডানা যদি মেলে দেন, সুদূরে বহু দূরে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী আপনার আমার ওজনের মূলে হিগস বোসন।
সার্ন গবেষণাগারে কম করে দুটো যন্ত্র হিগ্স খুঁজছে। পরমাণুর কণা প্রোটনকে সঙ্গে নিয়ে চলুন সার্ন-এর অতিকায় যন্ত্র লার্জ হেড্রন কোলাইডার (এল এইচ সি)-তে ঘুরে আসি।
প্রোটনগুলি এল এইচ সি-তে ঢুকছে তীব্র গতিতে, যা আলোর গতির প্রায় কাছাকাছি। আর আপনি ওই ফোটনটির উপর চড়ে বসেছেন। ২৭ কিলোমিটার টানেলের চার দিকে ফোটনের ওপর চড়ে পাঁই পাঁই করে ঘুরছেন আপনি। সেকেন্ডে ১১ হাজার বারেরও ওপর। (মাথা ঘুরছে না তো?) আর একটি প্রোটন (ধরা যাক আপনার মহা শত্রু) আর একটি একদম একই রকম টানেলে বিপরীত দিকে ঘুরছে। মোটামুটি চারটি জায়গায় দুই ফোটনে হচ্ছে সংঘর্ষ। এরই মধ্যে প্রোটনগুলি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার দৌলতে হয়েছে ভারী। দুই ভারী প্রোটনের সংঘর্ষে মিলেছে প্রচুর শক্তি। এই শক্তির গভীরে ঈশ্বর কণা কোথাও লুকিয়ে আছে। তারই হদিশ পাওয়ার জন্যই চলছে প্রচণ্ড তল্লাশ।
মূলত দুটি ডিটেক্টর। সিএমস আর অ্যাটলাস। দুটি যন্ত্রই হিগস বোসনদের খোঁজে ভীষণ ব্যস্ত। ওদের পাশাপাশি রয়েছে কলকাতার বিজ্ঞানীদের তৈরি ডিটেক্টর অ্যালিস। যেখানে সংঘর্ষ হচ্ছে, দুটি পরমাণু নিউক্লিয়াসের মধ্যে। মিলছে প্রচণ্ড এনার্জি। তৈরি হচ্ছে মৌলিক কণা কোয়ার্ক এবং গ্লুওন। যে সব কণাদের অস্তিত্ব ছিল ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের মাত্র এক মাইক্রোসেকেন্ড পরে।
অ্যাটলাস-এ কিছু দিন আগে একটি ফাজিল ছেলে ‘হিগস পেয়েছি, হিগস পেয়েছি’ বলে চেঁচামেচি শুরু করেছিল। তা-ও চুপিচুপি। দুই সপ্তাহ আগে যখন আমি সার্ন-এ ছিলাম, এক জন খুবই সিনিয়র বৈজ্ঞানিক ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ফাজিল ছেলেটিকে (ফুটবল খেলার ভাষায়) হলুদ কার্ড দেখানো হয়েছে। আর এক বার ফাউল, তার পরই বাইরে যাও।
এখন উঠেছে একটা মহাপ্রশ্ন। হিগস বোসন, যিনি কিনা সকল কণার ভর জোগান দেন, তাঁর ভর কত? সাধারণ যুক্তি বলে, তা নিশ্চয় ১১৪ জি ই ভি-র উপরে। জি ই ভি হল গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট বা ১,০০০,০০০,০০০ ইলেকট্রন ভোল্ট। (একটা ইলেকট্রন কণা এক ভোল্ট ব্যাটারির এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে যে শক্তি সঞ্চয় করে, তা হল ১ ইলেকট্রন ভোল্ট)। ইলেকট্রন ভোল্ট আসলে শক্তি বা এনার্জি-র একক। কিন্তু আইনস্টাইন যেহেতু আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, শক্তি আর ভর একই জিনিস, তাই ভরকে ইলেকট্রন ভোল্ট দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞানের মহাতত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী, হিগ্স কণার ভর হওয়া উচিত ১৬০ জি ই ভি। তবে অন্যান্য পরীক্ষা (যেমন, আমেরিকায় ফার্মিল্যাব-এ গবেষণা) থেকে বোঝা যাচ্ছে হিগ্স কণার ভর হতে পারে ১৪৪ থেকে ২০৭ জি ই ভি-র মধ্যে।
হিগস বোসন-এর অস্তিত্ব কি আদৌ আছে, না-কি তা শুধু কাগজে-কলমে? অস্তিত্ব না থাকাটা খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল-কল্পিত চিরাচরিত থিয়োরির হিগ্স বোসন না-ও থাকতে পারে। তা-ই যদি হয়, তা হলে হিগ্স বোসন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আর এক নতুন জগতের হদিশ মিলবে। বুঝতেই পারছেন উত্তেজনা কোথায় পৌঁছেছে।
হিগস বোসন আগের W বোসন-এ বিলীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের মস্তিষ্কপ্রসূত বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স-এর আবিষ্কারের পর এই প্রথম এক বোসন আবিষ্কৃত হতে চলেছে, যেটা আলোর কণা বা W এবং Z বোসন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর যদি হিগস বোসন না পাওয়া যায়, তবে ক্ষুধিত পাষাণ-এর ‘সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়, তফাত যাও’।
সাধারণ মানুষের কচকচানি, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, চেঁচামেচি, অকারণ কোলাহল, দৈনন্দিন জীবনের শেষ-না-হওয়া চাওয়ার সীমা নেই। সাধারণ জীবনের কর্কশ রূপ, দিনগত পাপক্ষয় এই আবিষ্কারের সাবলীল আনন্দ মানুষকে বহু উপরে তুলে নিয়ে যায়। উপলব্ধির দাঁড়িপাল্লায় কিছুটা সৌম্য শান্তি ফিরে আসে। জীবনের তাৎপর্য অন্য রূপে দেখা দেয়। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ হয়তো এত ভেবে উঠতে পারেননি। কিন্তু সেটাই তো বিরাট আবিষ্কারের অপূর্ব মাধুর্য অভাবনীয়কে ভাবনীয় করে তোলা।
লেখক হোমি ভাবা অধ্যাপক, পরমাণু শক্তি কমিশন
Previous Item Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.