|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
বন্ধ বন্ধ হউক |
বন্ধ-হরতালের সংস্কৃতি হইতে কিছুতেই বামপন্থীরা বাহির হইতে পারিতেছেন না। সর্বশেষ প্রমাণ বুধবার দুই সিটু নেতার হত্যার প্রতিবাদে শিলিগুড়িতে ডাকা তাঁহাদের বন্ধ। নামে সিটুর কর্মসূচি হইলেও সি পি আই এমের শ্রমিক সংগঠনের ডাকে শহরের সব কয়টি বাম দলের কর্মীরাই ময়দানে অবতীর্ণ হন। বন্ধ-সমর্থকরা অবরোধ, পিকেটিং ও বলপ্রয়োগ মারফত শিলিগুড়ির জনজীবন অচল করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়েন। গত চৌত্রিশ বছর ধরিয়া রাজ্যে যে প্রক্রিয়া ও কৌশলে ‘স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ’ বা হরতাল পালিত হইয়াছে, হুবহু তাহার পুনরভিনয়। কিন্তু বাম নেতারা টের পান নাই, তলে-তলে রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণের পাশাপাশি সমাজজীবনেও কিছু পরিবর্তন আসিয়া গিয়াছে। বন্ধ ডাকিলেই মানুষ আর ঘরে খিল আঁটিয়া বসিয়া থাকে না, বরং পথে বাহির হইতে চায়। শিলিগুড়ি সেই পরিবর্তন স্মরণ করাইয়া দিল।
পুলিশ হাত গুটাইয়া বন্ধ-এর তামাশা উপভোগ করিতেছিল। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের গুঁতায় তাহার সম্বিৎ ফেরে। বলপ্রয়োগে ব্যস্ত বন্ধ-সমর্থকদের হটাইয়া দিতেই জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় বাহির হইয়া আসেন। দোকান-পাট আগের মতোই খুলিয়া যায়, যানবাহনও চলিতে শুরু করে এবং নাগরিকরা নিজ-নিজ কাজে রওনা হন। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে অচলাবস্থা সৃষ্টির প্রবণতার বিরুদ্ধে মানুষের যে দীর্ঘকালীন ক্ষোভ সঞ্চিত রহিয়াছে, অতীতেও একাধিক উপলক্ষে তাহার প্রকাশ দেখা গিয়াছে। রেল-অবরোধে আটক নিত্যযাত্রীরা একাধিক বার অবরোধকারীদের মোকাবিলা করিয়াছেন, অবরোধ সরাইয়া লইতে তাহাদের বাধ্য করিয়াছেন। বুঝা গিয়াছে, মানুষ কোথাওই ‘স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে’ অচলাবস্থা সৃষ্টির আয়োজন সমর্থন করেন না। মানুষের নিরুপায় বাধ্যতাকে রাজনীতিকরা ‘স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া’ রূপে প্রচার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। যত দিন জবরদস্তি চালু জনজীবনকে অচল করার চেষ্টা চলিয়াছে, কতিপয় সাহসী ছাড়া বিশেষ কেহ সেই সংগঠিত ও যূথবদ্ধ রাজনৈতিক উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ জানান নাই। যখনই সেই উদ্যোগের প্রাচীরে সামান্য ফাটল নজরে আসিয়াছে, মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে সচেষ্ট হইয়াছে। শিলিগুড়িতে যাহা সম্ভব হইয়াছে, রাজ্যের অন্যত্রও, বস্তুত সর্বত্র তাহা সম্ভব হইবে, যদি রাজ্যের বর্তমান শাসক জোট অচলাবস্থা সৃষ্টির রাজনীতির নেতিবাচকতার প্রতি তাহাদের ঘোষিত বিরুদ্ধতায় অটল থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছেন, তাঁহার দল বন্ধ-হরতালের বিরোধী, মানুষের অসুবিধা করিয়া কোনও আন্দোলন করিবেন না। কংগ্রেসও মৌখিক ভাবে তাহা বলিয়া থাকে। কিন্তু উভয় দলেরই ধর্মঘট ডাকার ইতিহাস আছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে একাধিক বন্ধ তৃণমূল কংগ্রেসের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব হইত না। এখনও কি স্থানীয় ভাবে কিংবা শ্রমিক, ছাত্র-যুবদের শাখা সংগঠন মারফত এখানে-ওখানে ধর্মঘট ডাকিয়া অচলাবস্থা সৃষ্টির ঘটনা ঘটিতেছে না? কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়া কিছু আদায় করার পদ্ধতি হিসাবে ধর্মঘটের কার্যকারিতা বামপন্থীরা দীর্ঘ অনুশীলনে এমন স্বতঃসিদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিলেন যে, সহসা সেই অভ্যাসের বৃত্ত হইতে বাহির হওয়া কঠিন। কেবল রাজনীতিকদের সচেতন ও ধারাবাহিক প্রয়াসই ইহা সম্ভব করিতে পারে। শিলিগুড়ির মানুষ দেখাইয়াছেন, জনসাধারণ বন্ধ-ধর্মঘটের মতো নেতিবাচক ‘আন্দোলন’ বর্জন করিতে প্রস্তুত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখান, জনতার অভিপ্রায়কে সম্মান করার সততা তাঁহাদের আছে! |
|
|
|
|
|