|
|
|
|
আতঙ্কের যাত্রা: খোঁজ নেই দুই ট্রেনচালকের |
বেলাইন হওয়া এক্সপ্রেসে ধাক্কা প্যাসেঞ্জারের |
পীযূষ সাহা ও বিমান হাজরা • কালিয়াচক |
উত্তরপ্রদেশের মলওয়াঁর পরে মালদহের বাখরপুর। ব্যবধান ঠিক তিন সপ্তাহের।
গত ১০ জুলাই, রবিবার, মলওঁয়ায় লাইনচ্যুত হয়েছিল দিল্লি-হাওড়া কালকা মেল। আর এ দিন, রবিবার সন্ধ্যায় মালদহের কালিয়াচকের বাখরপুরে লাইনচ্যুত হল গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেস। এখানেই শেষ নয়। লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে পড়ে থাকা গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনকে এসে ধাক্কা মারল উল্টো দিক থেকে আসা আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জার! তবে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গতিবেগ কম থাকায় গত বছর জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে বলে রেল কর্তাদের দাবি। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। কয়েক জনের প্রাণহানির আশঙ্কাও করছে রেল পুলিশ ও প্রশাসন। দুর্ঘটনাস্থলে গভীর রাত পর্যন্ত পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না-হওয়ায় উদ্ধারের কাজে কিছুটা দেরি হয়েছে। উদ্ধারকার্য চালানোর সময় একটি মৃতদেহ মেলে। তবে রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর দাবি, লাইনে পড়ে থাকা ওই দেহটির সঙ্গে দুর্ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে পরে রেল সূত্রে বলা হয়, দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে ওই ব্যক্তির। যদিও তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
মালদহের এএসপি কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “বেশ কয়েকটি অচৈতন্য দেহ উদ্ধার হয়েছে। প্রাণহানির ব্যাপারে নিশ্চিত করে এখনই কিছু বলা যাবে না।” মালদহের জেলাশাসক রাজেশ সিংহ জানান, আহতদের মালদহ সদর-সহ নানা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রবিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বাখরপুরে প্রথমে লাইনচ্যুত হয় কলকাতামুখী ডাউন গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেস। তার ৭টি কামরা লাইনের ধারে কাত হয়ে যায় এবং ইঞ্জিনটি আপ লাইনের উপরে উঠে যায়। ঠিক ওই সময়ে উল্টো দিক থেকে মালদহের দিকে যাচ্ছিল আপ আজিমগঞ্জ-মালদহ প্যাসেঞ্জার। মুহূর্তের মধ্যে আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের। দু’টি ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জারের একটি কামরা ইঞ্জিনের উপরে উঠে যায়। আরও ৪টি কামরা কাত হয়ে লাইনের ধারে পড়ে যায়। ওই ঘটনার পরে কলকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সরাসরি রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সব ট্রেনই ঘুরপথে কাটিহার হয়ে চালানো হচ্ছে। রেল কর্তারা জানিয়েছেন, ওই লাইন দু’টি থেকে সমস্ত কামরা, ইঞ্জিন সরিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা লেগে যাবে। |
|
মালদহের বাখরপুরে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটি পর্যবেক্ষণ করছেন রেলের আধিকারিকরা। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়। |
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, দু’টি ট্রেনের চালক ও সহকারী চালক ঘটনাস্থল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় তাঁদের খোঁজ পাননি কর্তারা। এমনকী, ওই চার জন তাঁদের মোবাইল ফোনও বন্ধ করে দিয়েছেন বলে রেল সূত্রে খবর।
কী কারণে এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হল, তা রাত পর্যন্ত স্পষ্ট জানাতে পারেননি রেল কর্তারা। তবে এ দিনের দুর্ঘটনার সঙ্গে গত বছর মে মাসে ঘটে যাওয়া জ্ঞানেশ্বেরী এক্সপ্রেসের ঘটনার যথেষ্ট মিল পেয়েছেন তাঁরা। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে আসা দ্রুতগামী একটি মালগাড়িকে সজোরে ধাক্কা মেরেছিল। তাতে মৃত্যু হয়েছিল ১৬০ জনের। ওই ঘটনা যে নাশকতার ফল, তা তদন্তে প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু এ দিন কেন এমন হল, তা তদন্তের আগে বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন রেলের অফিসারেরা। তবে, প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চালকের তৎপরতাতেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে বলে রেল সূত্রে জানানো হয়েছে।
রেল সূত্রের খবর, দু’টি ট্রেনই নির্ধারিত সময়সূচি মেনে চলছিল। দুর্ঘটনাস্থল মালদহ স্টেশন থেকে বড়জোর ১০ কিলোমিটার দূরে। ওই সময়ে ডাউন গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরুর গতিও ছিল স্বাভাবিক। তা হলে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হল কেন? লাইনে কোনও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে? না লাইনে কোনও ত্রুটি ছিল? ট্রেনযাত্রীদের কয়েক জন অবশ্য বিকট শব্দ শুনেছেন বলে দাবি করেছেন। তা বিস্ফোরণের আওয়াজ হতে পারে বলে যাত্রীদের অনেকেরই সন্দেহ।
স্থানীয় সূত্রের বক্তব্য, এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ার মিনিট দুয়েক পরে আসে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি। প্রশ্ন উঠেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কথা বলা হলেও গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার খবর কেন প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চালককে দেওয়া হল না? অথচ এক্সপ্রেস ও প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চালকদের কাছে ওয়াকিটকি ও মোবাইল ফোন, দুই-ই ছিল। এক্সপ্রেসের চালক দুর্ঘটনার পরেই তাঁর ইঞ্জিনের ‘ফ্ল্যাশার ল্যাম্পটি’ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। দূর থেকে ওই লাল আলো দেখেই প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চালক ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ কষেন। তাতে মুখোমুখি ধাক্কা লাগলেও বড়সড় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে বলে রেলের দাবি। |
|
মালদহের ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার হর্ষ কুমার অবশ্য কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, “রেলের তরফে বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হচ্ছে। কমিশনই সব খতিয়ে দেখবে। নাশকতার কারণে গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু লাইনচু্যূত হয়েছে, না লাইনে ত্রুটির জন্য এমন দুর্ঘটনা, সবই দেখবে কমিশন।” রেলের একটি সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, ওই এলাকায় দু’দিন ধরে টানা বৃষ্টির জন্য লাইন বসে যেতে পারে। সেটাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ডিআরএম জানান, বৃষ্টির কারণে লাইনের কিছুটা অংশ বসে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা তিনিও শুনেছেন। তিনি জানান, ওই বিষয়টিও কমিশন দেখবে। রেল কর্তৃপক্ষ গোটা এলাকার ভিডিওগ্রাফি করছেন।
এই দুর্ঘটনার ফলে উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ও উত্তরবঙ্গগামী সব ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। ঘটনার খবর পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যোগাযোগ করেন রেলের আধিকারিকদের সঙ্গে। রেল বোর্ড এবং পূর্ব রেলের কর্তাদের থেকে ঘটনার বিস্তারিত খবর নেন। পরে তিনি জানান, বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে। উদ্ধার কাজও শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই মালদহ ও হাওড়া থেকে দু’টি রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে রওনা হয়। পূর্ব রেলের পদস্থ কর্তারা মেডিক্যাল টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। তবে আগে পৌঁছয় মালদহের রিলিফ ট্রেনটি। তারাই উদ্ধার কাজ শুরু করে দেয়। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে আরও একটি রিলিফ ট্রেন পাঠানোর ব্যবস্থা করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। মালদহের মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র এবং প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকার্য পরিচালনা করেন।
রেলমন্ত্রী বলেন, “দুর্ঘটনার তদন্ত হবে। কেন ট্রেন বার বার লাইনচ্যুত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।” তিনি আরও বলেন, মলওয়াঁর রেল দুর্
এনজেপি থেকে গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেস উঠেছিলেন শিলিগুড়ির শম্ভু কুমার, মহম্মদ ইলিয়াস-সহ ৭ জনের একটি দল। সকলেই কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরু যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মহম্মদ ইলিয়াস বললেন, “মালদহ থেকে ছাড়ার পরে ট্রেন মাঝারি গতিতে ছিল। হঠাৎ ভয়ঙ্কর শব্দ। সব আলো নিভে গেল। তীব্র ঝাঁকুনিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সিট থেকে। বুঝলাম, ট্রেন উল্টেছে। হইচই, চেঁচামেচির মধ্যে মাথা ঠান্ডা রেখে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে, হাতড়ে নীচে নামলাম। দেখলাম, ইঞ্জিনের উপরে ইঞ্জিন, তার প্রায় উপরে উঠে গিয়েছে একটা কামরা। ইঞ্জিনে আগুন জ্বলছে।” |
|
|
|
|
|