সমাবেশ শেষে ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে সবে নামতে যাবেন। কিছু সমর্থক এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল। জটলার মধ্যে এগিয়ে আসছে টিভি চ্যানেলের বুম। একটা ‘বাইট’ চাই! বুমকে ক্ষান্ত হতে বলে সমর্থকদের পায়ে পড়া আটকাতে গিয়েছিলেন ‘আরে থাক, থাক’ বলে। নিচু হওয়া মাত্র বুঝতে পারলেন, তিলমাত্র সুযোগে তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে প্লাস্টিকে মোড়া মোবাইল হ্যান্ডসেটটা কেউ তুলে নিচ্ছে! বৃষ্টির জন্যই প্লাস্টিকে মোড়া ছিল মোবাইল। ফলে খচমচ আওয়াজে টের পেয়েছিলেন কুকীর্তিটা! কিন্তু ওই ভিড়ে কাকে আর ধরবেন? কারই বা হাত চেপে আটকাবেন? অগত্যা চেনা নম্বর-হীন হয়েই দিন কাটছে। সিম-কার্ডটা ব্লক করিয়েছেন। নতুন কার্ডের জন্য নথিপত্র পাঠাতে হচ্ছে। বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক (যিনি আবার এক কালের দুঁদে বক্সারও বটে) শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ঘটনার সময় ‘সচেতন’ হয়েও আটকাতে পারলেন না!
|
প্রায় দু’মাসের অজ্ঞাতবাস শেষে আবার জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে। বিধানসভায় গিয়ে বামফ্রন্ট বিধায়কদের ঘরে ঢুকেছেন। বর্ধমানের এক বিধায়ক সোৎসাহে বললেন, “আরে গুরু, তুমি! তোমাকেই তো দেখতে এসেছি!” কিছুটা বিড়ম্বনার হাসি হাসলেন প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। একটু পরে ঘরে ঢুকলেন আরও এক প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। যিনি আপাতত বিধানসভার সরকারি আশ্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান এবং সেই কমিটিরই অন্যতম সদস্য সুশান্ত। সিপিএমের অন্দরে দু’জনের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। সুশান্তই প্রথম সম্বোধন করলেন, “রেজ্জাকদা, আমি এসে গিয়েছি! এই যে এ দিকে।” রেজ্জাকের ঝটিতি প্রত্যুত্তর, “আরে! ভাল করেছো! তুমি আর আমি তো মানিকজোড়! তুমিও খবরে, আমিও খবরে!” |
বিধানসভায় গোড়া থেকেই নিয়মিত আসতে শুরু করেছেন। মন দিয়ে আলোচনা শোনেন। একটি কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে বিধানসভায় এসেছিলেন তৃণমূলের তারকা-বিধায়ক চিরঞ্জিৎ। পর দিন নেতাজি ইন্ডোরে মোহনবাগান দিবসের অনুষ্ঠান। কাজ সেরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিধানসভার এক নিরাপত্তা-কর্মী বিদায় জানানোর জন্য উঠে দাঁড়াতে তাঁকে ওই অনুষ্ঠানের একটা কার্ড দিয়ে গেলেন চিরঞ্জিৎ। কার্ড-প্রাপক স্বভাবতই খুশি। অভিনেতা-বিধায়ক লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছেন। কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন বিধানসভার আরও কয়েক জন কর্মী। তাঁদেরও কার্ড চাই। নিরাশ করেননি নায়ক। দরাজ হাতে অনুষ্ঠানের কার্ড ধরিয়ে দিলেন। সিনেমার মতো। সব শেষে ইচ্ছেপূরণ।
|
বাম জমানায় বামফ্রন্টের বিভিন্ন দলের কর্মীরাই তাঁদের হাতে-থাকা সরকারি দফতরে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু অফিস করতে হত নামমাত্র। হাজার হোক, সরকারে তাঁদেরই দল! তবে এখন জমানা বদলেছে। ‘কড়া’ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পড়ে সরকারি কাজেও ফাঁকি দেওয়া চলছে না। বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য দফতরে যেমন সব সময় কাজ করার কর্মীর সংখ্যা এক ধাক্কায় বেশ কমে গিয়েছে। কারণ, বিভিন্ন সরকারি দফতরে কর্মরত দলীয় কর্মীরা সন্ধ্যার আগে দলের কার্যালয়ে আসতে পারছেন না! দিনের বেলাটা অগত্যা হাতে গোনা ‘বিকল্প’ কয়েক জনকে দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে! পরিস্থিতি মেনে নিয়েই দলের এক রাজ্য নেতা বলছেন, “জমানা বদলেছে। এখন তো সব আগের মতো থাকবে না! মানতে হবে।” |
মহাকরণে আটকে থাকতে তাঁর একেবারেই ভাল লাগে না। রোজ রোজ মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বসে একের পর এক বৈঠক করতে তো আরওই নয়। বরং তিনি অনেক স্বচ্ছন্দ বনে-জঙ্গলে। সুকনার মহানন্দা অভয়ারণ্যে গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে শুঁড়িপথের পাশের জমিতে খুঁটির উপর একটা পরিত্যক্ত কাঠের বাড়ি দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই বসলেন, “ইস! এখানে যদি এসে থাকতে পারতাম!” আফশোসটুকু ধরে রেখেই, “তা হলে কিন্তু আমার রাগও অনেক কম হত। আমি তো আর খাঁচার পাখি নই। বোধহয় হতেও পারব না কখনও।” |