এই ‘টিম’-এর কোচ নন শাহরুখ ‘কবীর’ খান। তবুও এই ‘টিম’-এর সদস্যেরা স্বপ্ন দেখেন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার। পেটের জ্বালা মিটিয়েও প্রতিদিন লড়াই করছেন তাঁরা। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার সন্দেশখালির ‘ন্যাজাট স্টেডিয়ামে’ এই মহিলা ফুটবলারেরা প্রতিদিন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। উজার করে দিচ্ছেন নিজেদের। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এলাকার মানুষকেও।
স্বপ্ন দেখার শুরুটা হয় বছর দু’য়েক আগে। তখন পাড়ার আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিচালি দিয়ে বল তৈরি করে তা প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুরে ফুটবল খেলছিল কয়েকটি মেয়ে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্বপ্না সর্দার ন্যাজাটে টুসু মেলার উদ্যোক্তাদের কাছে আচমকা দাবি করে, ‘একটা ফুটবল কিনে দাও না। আমরা খেলব।’ মেলার উদ্যোক্তারাও রাজি হয়ে যান। সেই শুরু। টুসু মেলার উদ্যোক্তাদের চেষ্টায় শুরু হয় মহিলা ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবির।
এলাকায় খেলাধূলার প্রসার ঘটাতে আশির দশকে স্থানীয় কয়েক জন মানুষ ১২ বিঘা জমি দিয়েছিলেন স্টেডিয়াম তৈরির জন্য। যদিও সরকারের তরফে কোনও সদর্থক প্রয়াস হয়নি। তবুও এলাকার মানুষের কাছে ওই ফাঁকা জমিটুকু ‘স্টেডিয়াম মাঠ’। তিন দিকে চাষের জমি, এক দিকে পুকুর। বর্ষার সময়ে ধানের খেতের মুখ লুকনো ওই মাঠে যেতে এক হাঁটু কাদা ভাঙতে হয়। মাঠের দু’ধারে ইউক্যালিপটাস গাছের খুঁটিতে বাঁশ বাঁধা গোলপোস্ট। নেট নেই। সেই মাঠেই প্রতিদিন পূর্ণিমা কর্মকার, সুভদ্রা সর্দার, নমিতা সর্দার, প্রিয়ঙ্কা সর্দার, মানা ভূমিজ, সুপ্রিয়া মাহাতো, স্বপ্না সর্দার, কুসুমিকা দাসেরা কসরত করেন। ফুটবল খেলেন। মাঠের পাশে মহিলাদের পোশাক পরিবর্তনের কোনও ঘর নেই। জল তেষ্টা পেলে যেতে হয় বেশ কিছুটা দূরে বড় রাস্তার পাশে টিউবয়েলে। টিফিন বলতে কখনও ছোলা, ছাতু অথবা বাদাম। তা-ও আবার কখনও জোটে, কখনও জোটে না। কিন্তু তাতেও অখুশি নয় মেয়েদের দল। |
সন্দেশখালি থানার দক্ষিণ আখড়াতলা গ্রামের মেয়ে পূর্ণিমা কর্মকার। ছোট থেকে শুরু করেছে বাঁচার লড়াই। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে সংসার চালাতেন কালীপদ কর্মকার। মাছের আড়তে কাজ করতেন। সামান্য টাকা মাইনে পেতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েদের নিয়ে সমস্যায় পড়েন কালীপদবাবুর স্ত্রী অমলাদেবী। সন্তানদের মানুষ করতে লোকের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন। তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত চার বোনের মধ্যে মেজ পূর্ণিমা। বাবার মৃত্যুর পরে আত্মীয়েরা দূরে সরিয়ে দিলে মায়ের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে সে। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়েনি। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার পাশাপাশি বাংলা দলের নির্ভরযোগ্য এই ফুটবলারের পাখির চোখ, দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা। আর একটা চাকরি। তাতেই হয়তো মোছাতে পারবে মায়ের চোখের জল।
নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া কুসুমিকা বলেন, “অভাব আমাকে থামাতে পারেনি। আধপেটা খেয়ে বেশির ভাগ রাত কাটে। তবু, আমার লক্ষ্য বড় ফুটবলার হওয়া।” বাংলা দলে খেলা নমিতা সর্দার বলেন, “বাবার মৃত্যুর পরে সংসার চালাতে মা পরিচারিকার কাজ করেন। আমার লড়াই মা-বোনদের জন্য। ভাল ভাবে বাঁচতে খেলাকে আশ্রয় করেই এগিয়ে যেতে চাই।” দ্বারিকজঙ্গলের কাঠখালির অনিমা সর্দারের বাড়ির হাল এতটাই খারাপ, উদ্যোক্তাদের তরফে সপ্তাহে দশ কেজি চাল পাঠাতে হয় তার বাড়িতে। না হলে খেলাধূলা মাথায় উঠবে সম্ভাবনাময় এই তরুণীর।
মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন স্থানীয় যুবক দিলীপ সর্দার, কমল সর্দারেরা। তাঁরা বলেন, “খেলার জন্য মেয়েগুলোর আবেদনে সাড়া না দিয়ে থাকা যায়নি। সে কারণে এলাকার গরিব আদিবাসী ও তফসিলি মেয়েদের নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির শুরু করা হয়েছে। এলাকার মানুষের আর্থিক সাহায্য নিয়ে সাধ্যমতো ওদের বল, বুট, জার্সি কিনে দিয়েছি। মেয়েদের জন্য পোশাক পরিবর্তনের ঘর, পানীয় জল, শৌচাগারের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে বলেও কাজ হয়নি।” |