|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
নষ্ট গাজন |
দুরনীতিতে ভারতের স্থান যে কোনও আন্তর্জাতিক তালিকার বেশ উপরের দিকেই। সমস্যাটি নূতন নহে। কে ভুলিতে পারে চাণক্য পণ্ডিতের দুই হাজার বছর আগেকার সেই উক্তি মাছ যেমন জল ছাড়া থাকিতে পারে না, সরকারি কর্মচারীও তেমনই ঘুষ ছাড়া বাঁচিতে পারে না। কমবেশি দুর্নীতি হয়তো সব দেশেই আছে, তবে ভারতে যে তাহা শতমুখ হাইড্রার ন্যায় দানবীয় আকার ধারণ করিয়াছে, তাহা স্পষ্ট। প্রশ্ন হইল, এই ব্যাধিটি দূর করার উপায় কী? সেই সূত্রেই লোকপাল বিল প্রণয়নের উদ্যোগ চলিতেছে, বিলের খসড়া ও এক্তিয়ার লইয়া রাজনৈতিক বিতর্কও তুঙ্গে উঠিয়াছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বিলের খসড়া অনুমোদন করিতেছে। আন্না হাজারেরা আবার অনশনের হুমকি দিতেছেন।
দুর্নীতির উপর নজরদারি চালানো, তাহা ফাঁস করা এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দিবার জন্য দেশে একাধিক সংস্থা রহিয়াছে। সি এ জি অর্থাৎ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন, আয়কর দফতর, সি বি আই, রাজস্ব গোয়েন্দা দফতর ইত্যাদি রকমারি প্রতিষ্ঠান সরকারি উচ্চ পদে ও ক্রিয়াকর্মে আর্থিক অনিয়ম এবং কেলেঙ্কারির উপর প্রহরারত। বিভিন্ন সময়ে এই সব প্রতিষ্ঠানের তরফে অনিয়মের নানা নমুনা পেশ করা হয়, প্রায়শ ওজনদার রাজনীতিক বা আমলাদেরও তাহাতে জড়াইয়া পড়ার খবর মেলে। তাঁহারা ধরাও পড়েন, অল্প কিছু কাল হয়তো কাহারও হাজতবাসও হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা সচরাচর জালের বাহিরেই থাকিয়া যায়। দুর্নীতির প্রকোপ যে তবু বাড়িয়াই চলিয়াছে, তাহার কারণ দুর্নীতি ফাঁস বা দমনের ক্ষমতাসম্পন্ন উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের অভাব নয়, বরং সুচারুরূপে সেগুলির কাজ করার সমস্যা। লোকপাল কি সে সমস্যার মীমাংসা করিতে পারিবে? যদি তাহা না পারে, তবে উপরিউক্ত সংস্থাগুলির সহিত আরও একটি প্রতিষ্ঠান যোগ করিয়া লাভ কী হইবে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাসক ও বিরোধী দলের বিবেকবান সংগ্রামীদের সচেতন তৎপরতা মানুষকে আশাবাদী করিয়াছে। দুর্নীতিগ্রস্তদের প্রতি যথাসময়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণে সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে দুর্নীতির প্রতি যে প্রশ্রয় নিহিত রহিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে সুশীল সমাজের বিশিষ্টজনদের আন্দোলন এবং আন্দোলনের দাবিগুলি শিরোধার্য করিয়া অ-নির্বাচিত মতামতকে সম্মান জানাইবার প্রবণতাও প্রশাসনের মানবিক মুখটি উন্মোচিত করিয়াছে।
কিন্তু আদৌ লোকপাল কেন, এবং দুর্নীতি নিরোধক বিভিন্ন সংস্থা এত কাল যাহা পারে নাই, লোকপাল তাহা কেমন করিয়া পারিবে, সেই প্রশ্নটি থাকিয়াই যায়। প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের পদস্থ বিচারপতিরা কিংবা আমলাতন্ত্রের শীর্ষস্থানীয়রা লোকপালের তদন্ত ও বিচারের অধীন হউন, সুশীল সমাজের এই দাবি সরকার প্রণীত সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে নাই। থাকিলেও সংসদে লোকপালের এই এক্তিয়ার লইয়া সর্বদলীয় ঐকমত্য অর্জন সম্ভব হইত না। কেননা লোকপাল পদে যাঁহারা নিযুক্ত হইবেন, তাঁহাদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার ঐক্যবদ্ধ অনুমোদনই কিন্তু ওই মর্যাদাপূর্ণ বিচারকদের যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার নিশ্ছিদ্র রক্ষাকবচ নয়। লোকপালের আইনগত এক্তিয়ার প্রয়োগ করিতে যে বহুসংখ্যক পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মী ও অন্য কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, তাঁহাদের সততাও প্রশ্নাতীত হওয়া উচিত। সেই সততার নিশ্চয়তাই বা কে দিবে? সুশীল সমাজ বরং আগে হইতেই দুর্নীতি দমনে গড়িয়া ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও নিরপেক্ষ ও সক্রিয় করিয়া তোলার জন্য আন্দোলন করিতে পারে। তাহাদের দক্ষতা, নির্ভীকতা ও সততার সহিত কাজ করা নিশ্চিত করিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখিতে সরকারকে চাপ দিতে পারে। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা সর্বদাই প্রচুর। একই কাজের জন্য একাধিক সংস্থা থাকিলে তাহা বিভ্রান্তি বাড়াইতে পারে। |
|
|
|
|
|