হোটেল-কর্তার মুক্তি, পণ দিতে হল কি না ধোঁয়াশা
কালো কাপড়ে দু’জনেরই চোখ বাঁধা। এক জন প্রৌঢ়। অন্য জন যুবক।
সবুজ মারুতি ভ্যান থেকে নামানো হল দু’জনকে। গাড়ির ভিতর থেকে এক জন হিন্দিতে নির্দেশ দিল, ‘একশো কদম হাঁটতে থাক নাক বরাবর।’ তার পরেই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল ভ্যানটি।
ঘটনাস্থল কিউল স্টেশন। সময় রবিবার সকাল ৬টা। কিছু ক্ষণের মধ্যে চোখ বাঁধা দু’জনকে উদ্ধার করল পুলিশ। ওই দু’জন হলেন ধানবাদের হোটেল-কর্তা উদয়শঙ্কর চন্দ এবং তাঁর গাড়ির চালক দিলীপ সিংহ।
গত ২ জুলাই ধানবাদ থেকে কলকাতার বাড়িতে ফেরার পথে কুলটির কাছে নিখোঁজ হন তাঁরা। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, বিহারের একটি অপহরণকারী দলের খপ্পরে পড়েছেন তাঁরা। ঝাড়খণ্ডের পুলিশ সুপার রবিকান্ত থানের নেতৃত্বে পাঁচ জনের একটি তদন্তকারী দল গড়া হয়।
ঠাকুরপুকুরের বাড়িতে উদয়শঙ্কর চন্দ। নিজস্ব চিত্র
এ দিন মুক্তির পরে তাঁদের দু’জনকে কলকাতার ঠাকুরপুকুরের বাড়িতে পৌঁছে দেয় পুলিশ। ২৯ দিন অপহরণকারীদের ডেরায় থাকার পরে বাড়ি ফিরে উদয়বাবু বলেন, “প্রতিদিনের ওই যন্ত্রণার থেকে মৃত্যুও মনে হয় ভাল ছিল!” তবে তাঁরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন কি না বা দিয়ে থাকলে তার পরিমাণ কত, সেই ব্যাপারে সংশয় কাটেনি। উদয়বাবু এই বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।
২০০৪ সালে বহুজাতিক সংস্থার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে উদয়বাবু ধানবাদের একটি হোটেলের ডিরেক্টরের পদে যোগ দেন। ঝাড়খণ্ডের পুলিশ জানিয়েছে, তিনি একটি আন্তঃরাজ্য অপহরণ চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন। তদন্তকারী দলের নেতা, ধানবাদের ডিএসপি সঞ্জয় রঞ্জন এ দিন বলেন, “তদন্তের স্বার্থে এখনই বেশি কিছু বলা যাবে না। বিহারের একটি দল উদয়বাবুকে অপহরণ করেছিল।” অপহরণকারীরা মুক্তিপণ চেয়ে উদয়বাবুর পরিজনদের কোনও ফোন করেছিল কি না, সেই ব্যাপারেও কিছু বলতে চায়নি পুলিশ। ২৯ দিন দু’জনকে নিজেদের ডেরায় রাখার পরে কী পরিস্থিতিতে পড়ে অপহরণকারীরা তাঁদের মুক্তি দিল, সেই বিষয়েও মুখ খুলতে চাননি পুলিশকর্তারা। এই অপহরণ কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে ধানবাদ পুলিশ।
উদয়বাবু ও দিলীপবাবুকে উদ্ধার করা হল কী ভাবে?
তদন্তকারীরা জানান, শেষ বার কুলটির কাছে থাকাকালীন উদয়বাবু মোবাইলে কথা বলেছিলেন বলে তাঁরা জানতে পারেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তদন্ত। জানা যায়, অপহরণকারীরা উদয়বাবুকে নিয়ে গিয়েছে লখিসরাইয়ের দিকে। সেখানে অন্য একটি দলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। যে-দলটি অপহরণের সঙ্গে যুক্ত, তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, প্রতি সপ্তাহে নিজের গাড়িতে উদয়বাবু কলকাতায় আসতেন। রীতিমতো ছক কষেই তারা কুলটি এলাকার গোবিনপুরের কাছ থেকে দু’জনকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, তদন্তকারীদের কাছে খবর ছিল, অপহরণকারীরা কিউল বা সংলগ্ন কোনও এলাকায় রয়েছে। রবিবার সকালেই তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে। সেই অনুসারে এ দিন সকালে কিউল স্টেশনের কাছে ঘাপটি মেরে ছিল পুলিশ। অপহরণকারীরা গাড়ি থেকে উদয়বাবুদের নামানোর কিছু পরেই তাঁদের উদ্ধার করা হয়। পুলিশের দাবি, মারুতি ভ্যানটির উপরেও নজর রাখা হয়েছে। ওই সূত্র ধরেই চক্রের চাঁইদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা চলছে বলে জানায় পুলিশ।
এ দিন বিকেলে ঠাকুরপুকুরের মাঝিপাড়ায় উদয়বাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বস্তি ফিরেছে পরিবার-পরিজনদের মধ্যে। দৃশ্যত ক্লান্ত উদয়বাবু খুব বেশি কিছু বলতে চাননি তবে জানান, ঘটনার দিন বেলা ২টো নাগাদ কুলটি পেরিয়ে কলকাতার দিকে আসছিলেন তাঁরা। উদয়বাবু বলেন, “তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের গাড়ির সামনে ছিল দু’তিনটে গাড়ি। কিছুটা এগোতেই দেখি, একটা তেলের ট্যাঙ্কার সামনে রয়েছে। দিলীপ বারবার হর্ন দেওয়া সত্ত্বেও ট্যাঙ্কারের চালক কিছুতেই জায়গা ছাড়ছিল না।” দিলীপবাবু কোনও মতে ট্যাঙ্কারটাকে কাটাতেই পিছন থেকে একটি সবুজ ভ্যান এসে তাঁদের পথ আটকায় বলে জানান উদয়বাবু। তিনি জানান, কিছু বোঝার আগেই ওই গাড়ি থেকে নেমে আসে দু’তিন জন। গাড়ি থেকে উদয়বাবু ও দিলীপকে নামায় দুষ্কৃতীরা। উদয়বাবু বলেন, “কিছু বলার আগেই আমাদের ঘুষি মারতে থাকে ওরা। তার পরে ধাক্কা মারতে মারতে ভ্যানে তুলে নেয়। বলতে থাকে, ‘ইনকাম ট্যাক্সের অনেক টাকা মেরেছিস। চল, তোদের সবক শেখাচ্ছি’।”
উদয়বাবু জানান, গাড়িতে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের চোখ, মুখ ও হাত বেঁধে দেয় দুষ্কৃতীরা। তাঁর অনুমান, রাত ৮টা নাগাদ গাড়ি থামে। নামানো হয় তাঁদের। কিছু পরে খুলে দেওয়া হয় চোখ। তাঁরা বুঝতে পারেন, একটা বাড়ির ভিতরে আনা হয়েছে তাঁদের।
উদয়বাবুর গাড়ির চালক দিলীপবাবু এ দিন বলেন, “কখনওই ওই বাড়ির বাইরে বার করা হয়নি আমাদের। জানলা-দরজাও খুব একটা খোলা হত না। আর সব সময়েই দুষ্কৃতীদের মুখ কাপড়ে বাঁধা থাকত। ফলে ওদের কাউকেই চিনতে পারিনি। নিজেদের মধ্যে হিন্দি-বাংলায় কথা বলত ওরা।” তাঁরা জানান, দুষ্কৃতীরা ঠিক সময়ে তাঁদের খাবার দিয়ে যেত। কিন্তু তাঁদের শৌচাগারে যেতে হত দরজা খোলা রেখে। যে-বাড়িতে রাখা হয়েছিল, সেখানকার অন্য কোনও বাসিন্দার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি বলে জানান উদয়বাবু। তিনি জানান, এক বার তাঁকে একটা চিঠি লিখতে দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার সেই চিঠি পান তাঁর ছেলে রাহুল।
বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের রাহুল বলেন, “চিঠির হাতের লেখা বাবারই ছিল। বাবা লিখেছিল, ‘ভাল আছি। আমার জন্য চিন্তা কোরো না।” উদয়বাবু তাঁদের যতই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, প্রায় একটি মাস প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে কেটেছে পরিবারের সকলেরই। দুষ্কৃতীরা ইতিমধ্যেই উদয়বাবুকে জানায়, পুলিশ-প্রশাসনের ‘চাপ’ রয়েছে তাদের উপরে। তাই তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে তারা।
First Page Desh Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.