|
|
|
|
|
|
|
বাবার মৃত্যু |
শামিম আহমেদ |
বাড়ির সামনে গাড়িটা এসে দাঁড়াল। স্বর্গরথ।
শববাহী গাড়ি।
শান্তপল্লি থেকে যাবে বোড়াল শ্মশান। ঘিঞ্জি রাস্তা। অটো রিকশা আর সাইকেল রিকশার দাপটে সর্বক্ষণ জ্যাম লেগেই আছে। ওই রাস্তা দিয়েই স্বর্গরথে চেপে বাবা যাবেন। জ্যাম ঠেলে, অপ্রশস্ত রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। স্বর্গরথের জন্য আলাদা কোনও সুবিধা নেই।
তার পর কয়েক ঘণ্টার মামলা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অর্থাৎ শ্মশানে ভিড় না থাকলে এক ঘণ্টায় সব শেষ। সত্তর বছরের দীর্ঘ জীবনে যে শরীর বেড়ে উঠেছিল, জরায় অথবা ক্লান্তিতে কিংবা কাছের মানুষের অত্যাচারে ভঙ্গুর হচ্ছিল যে দেহ, সেই মধুময় বা বিষময় জীবনের আনুষ্ঠানিক বিদায়।
জীবিত অবস্থায় যে প্যান্ট-শার্ট পরেছিলেন তিনি, তাই পরে আছেন এখনও। শার্টটা এখনও প্যান্টের ভেতর গোঁজা। সকালবেলার নিখুঁত ভাবে দাড়ি কামানো গালে সবুজ আভা।
দাড়ি কেটে, স্নান সেরে বেরিয়েছিলেন সকালেই। কাজ সেরে বিকেলে যখন সুঅঙ্গনাকে আনতে যান, তখনও বোঝা যায়নি কিছু। দুপুরে কলেজ স্ট্রিটে ট্যাংরা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন নীলুদার হোটেলে। বরাবরই দুপুরে ওখানেই খেতেন বাবা, ছুটির দিন ছাড়া। ভাত খেয়ে গিয়েছিলেন পিসির বাড়ি দমদম। সেখান থেকে চারটের সময় পৌঁছন বালিগঞ্জ। সুঅঙ্গনাকে তুলে সাড়ে চারটেই নিজের বাড়ি। মারা গেলেন ঠিক তার মিনিট পাঁচেক পর। গাড়িতেই সুঅঙ্গনা বুঝতে পেরেছিল, বাবার শরীরটা ভাল নেই। কোথাও একটা তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে বাবা বুকে হাত ঘষছিলেন। পেছনে সুঅঙ্গনা আর পিসি। সুঅঙ্গনা বলেছিল, ‘কষ্ট হচ্ছে বাবা?’ পিসি বলেছিলেন, ‘হাসপাতাল নিয়ে চলো।’ বাবা বলেছিলেন, ‘তেমন কিছু না, একটু অ্যাসিড হয়েছে মনে হচ্ছে।’ পিসির কথা মতো ড্রাইভারকে হাসপাতাল যেতে বলে সুঅঙ্গনা। বাবা যাননি। ড্রাইভারকে বাড়ি ফিরতেই বলেছিলেন। সে বেচারা আর কী করে! মালিকের কথা শুনে বাড়ির দিকেই যায়। বাড়ি পৌঁছে সটান নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছিলেন বাবা। পিসিকে বলেছিলেন, ‘দিদি, বুকটা একটু ডলে দাও তো। বড্ড ব্যথা!’ সুঅঙ্গনা ততক্ষণে অ্যাম্বুল্যান্সে ফোন করেছে। অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছনোর আগেই সব শেষ।
এর পর আর পাঁচটা মৃত্যুর গল্পের মতো বাড়িতে লোক জন আসতে শুরু করে। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিচিতরা ধীরে ধীরে আসতে আরম্ভ করেন। কান্নার রোল ওঠে। প্রচুর অপরিচিত লোকেরা এসে ভিড় জমায়। কস্মিনকালে দেখেনি এমন লোককেও কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। সুঅঙ্গনা সেই তুলনায় অনেক সংযত, শান্ত ও ধীর। শোকের আপাতদৃশ্যে তার এমন কথাও এক বার মনে হল যে, বাবা বোধ হয় ওই লোকজনদেরই খুব আপন ছিলেন, সুঅঙ্গনার নয়। তবে এটা ঠিক কথা যে, আত্মীয় ও পরিচিত মহলে বাবার একটা সুখ্যাতি ছিল। অনাত্মীয় মানুষের বিপদেও তিনি এমন ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন যে, কেউ কেউ তাঁকে দেবতার মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। অনেক লোককেই প্রতি মাসে নিয়ম করে অর্থসাহায্য করতেন। সেই সব মানুষের ভেঙে পড়া মুখ দেখে মনে হয়, বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এঁরা অথৈ জলে পড়লেন। এঁদের কান্নার তবু একটা মানে আছে। |
|
কিন্তু মা কেন কাঁদছেন, সেটা সুঅঙ্গনার বোধগম্য নয়। বাবা বেঁচে থাকতে মা’র সঙ্গে কোনও সম্পর্কই ছিল না। সুঅঙ্গনা জ্ঞান হওয়া ইস্তক তাই দেখে আসছে। দু’জনের আলাদা ঘর, ভিন্ন রান্না। মা-বাবা দু’জনেই বেরিয়ে যেতেন সকাল-সকাল। মা-র অফিস, বাবার ব্যবসা। বাবা ফেরেন সন্ধ্যায়, মা অনেক রাতে। মানু মাসির কাছে স্নান খাওয়া, তার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। ঘুমোত মা-র ঘরেই। তার পর নিজের একটা আলাদা ঘর, বড় হয়ে ওঠা। এখন অবশ্য সে আর এ বাড়িতেই থাকে না। থাকে রাজার সঙ্গে বালিগঞ্জে।
বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে রাজা সুঅঙ্গনাকে বলল, ‘আমি আর তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি না, সোজা শ্মশানে চলে যাব।’ এমন দিনেও রাজা অপমান মনে রেখেছে। তা রাখবে না-ই বা কেন! বিয়ের পর সুঅঙ্গনা নিয়মিত বাপের বাড়ি এলেও রাজা কখনও এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায়নি। সুঅঙ্গনার সঙ্গে তার বিয়ে নিয়ে বাবার ঘোরতর আপত্তি ছিল। এই একটা বিষয়ে বাবার অবস্থানকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সে। রাজা শিক্ষিত ছেলে, ভাল চাকরি করে অথচ সুঅঙ্গনার সঙ্গে তার বিয়ের কথা শুনেই বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভিন্ন গোত্রে আমার মেয়ের বিয়ে হোক, এ আমি কিছুতেই মেনে নেব না।’ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ বোঝাতে পারেনি। বাবা অনড় ছিলেন, কারণ রাজা গোত্র আলাদা। সুঅঙ্গনা বাবার জেদের সঙ্গে পরিচিত, তাই সে আর কথা বাড়ায়নি। বাবাকে না জানিয়েই রেজিস্ট্রি করেছিল। বিয়ের পরের হপ্তায় বাড়িতেও এসেছিল একা। ‘বাবা, কিছুই হয়নি’ গোছের ভান করেছিলেন। তবে বাবার সঙ্গে প্রায় দু’মাস কথা ছিল না সুঅঙ্গনার।
তার পর ধীরে ধীরে অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছিল কালের নিয়মে। একমাত্র রাজাকে মেনে নেননি বাবা, বা বলা ভাল, রাজার বউ সুঅঙ্গনাকে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। তবে রাজাদের বাড়ির সামনে থেকে মেয়েকে নিয়ে আসতেন তিনি, বাড়িতে ঢুকতেন না। মা অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন সব কিছু। বাবার প্রসঙ্গে মায়ের মন্তব্য ছিল, ‘চিরকালের গোঁয়ার! নেক্সট টাইম প্রকাশ্যে এমন বেজাত-কুজাত বললে তুই মানহানির মামলা ঠুকে দিস, আমি সাক্ষী দেব।’ সুঅঙ্গনার খুব খারাপ লাগলেও সে বাবার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবে, এমন কথা স্বপ্নেও ভাবে না। অথচ বাবার এই অবস্থানকেও সে মেনে নিতে পারে না। কারণ, তার বাবার অন্য আর একটা চেহারাও আছে, যেটা সে নিজের চোখে দেখে এসেছে আর তাতে বাবার প্রতি শ্রদ্ধাটাও ছিল অনেকখানি।
বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে সবার আগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা বাবার ব্যবসার লোক। কেউ কর্মচারী, কেউ বা অংশীদার। ভিন্ন ধর্মের লোকও সেখানে কম নেই। সে সব লোকজনের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক খুব ভাল। বাড়ির উৎসবে-পার্বণে সুঅঙ্গনা দেখেছে, বাবা যাঁদের সঙ্গে বসে খাবার বা পানীয় খাচ্ছেন, তাস খেলছেন তাঁরা নানা শ্রেণির লোক। তাঁদের আর্থ-সামাজিক চরিত্র বাবার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। অথচ অন্যের ধরানো সিগারেট খেতে বাবার অসুবিধা হয়নি। মদ খাওয়ার সময় কার গ্লাস কোনটা, অনেক সময় তাও গুলিয়ে গেছে। সুঅঙ্গনা কোনও দিন পাঁপড় ভাজা বা চানাচুর দিতে এসে তা খেয়ালও করেছে। সে দিনের কিশোরী সুঅঙ্গনা এতে বেশ রেগেই যেত। বলত, ‘তুমি কেন অন্য লোকের এঁটো খাবে বাবা, ছিঃ!’ বাবা হাসতেন, বলতেন, ‘সব মানুষ সমান মা।’ ‘এটা সমান-অসমানের প্রশ্ন না, আসলে ব্যাপারটা হল হাইজিন।’ কিশোরী মেয়ের এই যুক্তি শুনে বাবা হার মানতেন এবং হাসতেন। সেই বাবা! সেই বাবাই রাজাকে আর মানুষ বলে মনে করেননি। নইলে বলেন, ‘একটা অজাতের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হোক, এটা আমি মেনে নিতে পারব না।’ ছি! সুঅঙ্গনা যেন মানুষ না, কোনও কুকুর বা বেড়ালের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছে। এই দুই বাবাকে আজও মেলাতে পারে না সে। এই মৃতদেহ, তার পাশে ধূপের সর্পিল ঊর্ধ্বগমন তার চিন্তাকে আরও ঘোরালো করে তুলছে। সুঅঙ্গনা বুঝে উঠতে পারছে না, কেন আজই তার এই সব চিন্তা মাথায় আসছে। |
|
হঠাৎ তার মনে পড়ল বাবার ছোটবেলার কথা, বাবার কাছে থেকেই শোনা। খুব কষ্ট করে বড় হয়েছিলেন তার বাবা। আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, বাবাদের নাকি দু’বেলা খাবারও জুটত না। সেই বাবা পরে দু’হাতে রোজগার করেছেন। বাবা মারা গেলে কী হবে, তার টাকারা অবশ্য এখনও বেঁচে আছে, সেই টাকাতেই শ্রাদ্ধ হবে, মা ফুর্তি করবে; সুঅঙ্গনা শাড়ি-গয়না কিনবে। বাবা বেঁচে থাকতেও দু’হাতে খরচ করেছে তারা সকলেই। ছোটবেলা থেকেই কোনও কিছুর অভাব বোধ করেনি সুঅঙ্গনা। যখন যেটা চেয়েছে, তখনই সেটা পেয়েছে। এমনকী বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও। মাত্র মাস তিনেক বাদ দিলে বাবা তাকে হাতখরচের টাকাও দিয়ে গেছেন সমানে। সেও চাকরি করে। তা সত্ত্বেও বাবা তাকে টাকা দেবেনই। এমনই সম্পর্ক ছিল বাবা-মেয়ের।
কিন্তু ছোটবেলা থেকে একটা ব্যাপার তাকে পীড়া দিয়ে এসেছে তা হল, বাবা-মা’র সম্পর্ক। এক ছাদের নীচে দুটো মানুষ, অথচ কী নিস্পৃহ দু’জনের সম্পর্ক। খাতায়-কলমে তাঁরা বর-বউ, কিন্তু এই অস্বাভাবিক সহবাস তার কাছে সব সময়েই দুঃসহ মনে হয়েছে। বাবা-মা’র ভাল সম্পর্ক তো দূরে থাক, তেমন ভাবে কোনও দিন তেড়ে ঝগড়াও করতে দেখেনি সে, যাতে করে মনে হয় তাঁদের সম্পর্কটা হয়তো কোথাও একটা জীবিত আছে। দু’জনের জীবন যেন সম্পূর্ণ আলাদা, কেউ কারও ধার মাড়ায় না। কাজের লোকের মাইনে বাবাই দিয়ে এসেছেন বরাবর। বাড়ির বাজার হাট ওই মৃত মানুষটাই করে এসেছেন এত কাল। পিতৃহারা সুঅঙ্গনা আজ বুঝে উঠতে পারছে না, মা কি সত্যিই বিধবা হলেন? সে জানে না। ফুল কেনার জন্য মামাকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠায় সে।
আচ্ছা, বাবা-মা’র কি ফুলশয্যা হয়েছিল? নিশ্চয় হয়েছিল। সেই ফুলগুলো যদি কাগজের অথবা প্লাস্টিকের হত, তা হলে আজ বাবার মৃতদেহে সেগুলো চাপালে বেশ হত। সুঅঙ্গনা ভাবল, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি, না নিষ্ঠুর? এ রকম সম্পর্ক বা সম্পর্কহীনতা নিয়ে হাজার হাজার লোক বাস করে, খায়দায়, তার পর এক দিন হুশ করে মরে যায়। সব মায়া, মিথ্যা এই জগৎ। তবে সত্যিটাই বা কী, কে আর জানে!
সত্যি বোধ হয় সম্পর্কহীনতা। আর তা নিয়ে একত্রে বেঁচে থাকা। মরে যাওয়া সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকারই বা কী মানে? এই প্রশ্নটা সে বহু দিন আগে বাবা-মা দু’জনকেই করেছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘কারণটা তুমি।’ মা’র উত্তর ছিল, ‘তোমার বাবা সমাজকে ভয় পায়।’
মৃত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সুঅঙ্গনার পুনরায় মনে হল, যদি তার কথা ভেবে বিবাহবিচ্ছেদ না হয়ে থাকে তা হলে সেই যুক্তিহীনতাকেও কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তার মঙ্গলের কথা ভেবে, আবার তাকেই চূড়ান্ত একটা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কহীনতার মধ্যে রেখে বাবা-মা তার কোন ভালটা করলেন! মা’র কথাটাও আর এক বার মনে হল তার। বাবা সমাজকে ভয় পান! কচু! সমাজ আবার কী রে! বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় যে সব লোক, তারা অন্যদের সম্পর্কে ভাবে, ও নিশ্চয় সমাজকে ভয় পায়। আসলে এক একটা মানুষ রিপুর কাছে এমন ভাবে ক্রীতদাস হয়ে পড়ে যে, যখন যা খুশি তাই যুক্তি বানায়। বাবা সমাজকে ভয় পেতেন না, এ কথাটা সুঅঙ্গনার চেয়ে ভাল আর কেই-বা জানে। ডাকাবুকো লোক, এমন মানুষকে চিরদিন আদর্শ পুরুষের স্থান দিয়েছে সে। বাবার মতো মানুষ সে এই পৃথিবীতে আর দুটো দেখেনি। এক রাজার ব্যাপারটা বাদ দিলে বাবার চরিত্রে আর কোনও দাগ নেই। এই সম্পর্কহীনতার জন্য সে মাকেই দায়ী করে এসেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, দুটো লোকের মন মরে গেলে কি শরীরও মরে যায়? তাদের কি কোনও শারীরিক চাহিদাও থাকতে নেই? মা’র সম্পর্কে সে অনেক কথা শুনেছে। অফিসের কোন কলিগের সঙ্গে টুরের নাম করে মা বেড়াতে যায়। এক বন্ধুর মাসি মা’র অফিসে কাজ করেন। সেই বন্ধুর কাছেই সুঅঙ্গনা যা শুনেছে, তা কাউকেই বলা যায় না। মা নাকি নিম্ফোম্যানিয়াক! এক জন নয়, বহু লোকের সঙ্গেই মা নিয়মিত সম্পর্ক রাখে।বাবা! তার মৃত বাবা কী পেলেন এই দাম্পত্যে! শুধু অবহেলা, মা’র ঘৃণা; আর টাকা জুগিয়ে গেলেন চিরটাকাল। এ সবের মাঝেও বাবার চরিত্রে কোনও দাগ ছিল না। মেরুদণ্ড সোজা করেই চলেছেন তিনি। যেমন মৃত অবস্থায় টান টান শুয়ে আছেন বিছানায়।
সুঅঙ্গনাদের গাড়িটা চলেছে শববাহী গাড়ির ঠিক পেছনেই। বাবা স্বর্গরথে শুয়ে আছেন। সারা শরীর ফুলে ঢেকে গিয়েছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়ারা উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার জ্যামে আটকে যাচ্ছে স্বর্গরথ, তার ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে অটো রিকশা, মোটর সাইকেল। পথচলতি মানুষের কেউ কেউ স্বর্গরথের দিকে হাত তুলে নমস্কার করছে। সুঅঙ্গনার মনে হল, এই হল বাবার অন্তিম যাত্রা। শ্মশানে পৌঁছলেই সব শেষ। সব সম্পর্ক, সম্পর্কহীনতা কাটিয়ে যে বাবা চলে গিয়েছেন বিকেলবেলায়, আজ রাতেই তাঁর ছাইচাপা আগুনের মতো দেহটাও আর থাকবে না। ভস্ম হয়ে যাবে।
শ্মশানে পৌঁছে জানা যায়, সুঅঙ্গনার বাবার আগে আরও পাঁচটা ডেডবডি আছে। ঠিকঠাক লাইন এগোলেও রাত বারোটার আগে বডি পুড়বে না। জ্যাঠামশাই বললেন, ‘ভালই হয়েছে, অত রাতে বাবুঘাটে কোনও পুলিশ থাকে না; অস্থিকলসটা ওখানেই বিসর্জন দিতে পারব। এখন তো আবার পলিউশনের জন্য গঙ্গায় কিছু ফেলা যাবে না!’
একটা গাছের নীচে সিমেন্টের বেঞ্চিতে সুঅঙ্গনারা বসে। পাশে জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, মামাতো ভাইবোনেরা। বউ, জামাই। অনেক লোক। কেউ কেউ ডেডবডির সঙ্গেই এসেছে, কেউ বা পরে। অনেকেই গিয়ে বাবার পায়ে প্রণাম করে আসছে। বাবার দেহটা একটা চাতালে শোয়ানো। চার দিক বেশ নিস্তব্ধ। কেউ আর কাঁদছে না। শ্মশান বোধ হয় সব কান্নাকে মৃতদেহের মতো গিলে ফেলে। সুরূপার সঙ্গে যারা এসেছে, তারা কেউ কেউ চা-বিস্কুট খাচ্ছে। শ্মশানে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। পাশেই পাইস হোটেল, সস্তার রেস্তোরা।ঁ সেখান থেকে কেউ একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক এনে সুঅঙ্গনাকে দিল। খেতে ইচ্ছে না করলেও সুঅঙ্গনা চুমুক দেওয়ার পর বুঝতে পারল তার ভয়ঙ্কর তেষ্টা পেয়েছিল। ‘আর কতক্ষণ?’ সুঅঙ্গনা কারও দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করল। কাকা বললেন, ‘এই তো, তিন নম্বর পুড়ছে।’
বাবা ছ’নম্বর। মানে, মাঝখানে আরও দু’জন।
এমন সময় দু’জন এসে ঢুকল শ্মশানে। এক মহিলা, সঙ্গে চোদ্দো-পনেরো বছরের একটি কিশোর। ছেলেটিকে খুব চেনা-চেনা লাগছে সুঅঙ্গনার। কোথাও যেন দেখেছে, অথচ মনে করতে পারছে না কিছুতেই। ওদের সঙ্গে কথা বলতে জেঠু উঠে গেলেন। ভদ্রমহিলা জেঠুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। মায়ের দেখাদেখি ছেলেটিও। জেঠুই ওদের নিয়ে গেলেন বাবার ডেডবডির কাছে। ভদ্রমহিলা বাবার পায়ে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ছেলেটি শুকনো মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সুঅঙ্গনা তাদের চিনতে পারল না। ছেলেটিকে পরিচিত বলে মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু মহিলাকে কোনও দিন দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। বাবার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। জেঠতুতো দাদা বলল, ‘চিনতে পারছি না। তবে মানুষ মারা গেলে তো কত লোকই আসে। তা ছাড়া তোর বাবা মানে কাকু তো ছিলেন হরিশচন্দ্র। দান-খয়রাত তো কম করতেন না। তাদেরই কেউ একটা হবে। এ বার তো টাকা বন্ধ হবে। সেই শোকেই...’
সুঅঙ্গনা দেখল, ভদ্রমহিলা বাবার পায়ে মাথা রেখে কেঁদেই চলেছেন। এ দিকে চুল্লিতে চার নম্বর ঢুকেছে। এক মহিলার বডি, ছোটখাটো চেহারার। পিসেমশাই খবর আনলেন আর সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন, ‘বেশিক্ষণ লাগবে না। ওই ধরো মিনিট পঁয়তাল্লিশ।’ সুঅঙ্গনা দেখল, জ্যাঠামশাই ভদ্রমহিলাকে উঠতে বলছেন। ভদ্রমহিলা উঠে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। |
|
এর মধ্যে রাজা এল। সুঅঙ্গনার পাশে বসল। তার পর নানা ভাবে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সুঅঙ্গনা বলল, ‘প্লিজ রাজা, একটু চুপ করে বসো। কথা বোলো না।’
রাজা বলল, ‘ওকে, ওকে। আচ্ছা জাস্ট একটা কোয়েশ্চন। তোমার বাবার মুখাগ্নি করবে কে? তোমার জেঠু-টেঠুরা আবার মেয়েকে দিয়ে সে সব করাবেন তো?’
যিনি মারা গিয়েছেন, তিনি আমার বাবা। আমি যা বলব, সেটাই ফাইনাল। জেঠুরা আবার কী বলবেন!
না, মানে মুখাগ্নি করাটা তো বেশ শক্ত কাজ। তোমার বাবা বলেই হয়তো তোমার কষ্ট হবে, তাই বলছিলাম আর কী! জেঠতুতো দাদারা কেউ করলেই বা ক্ষতি কী!
সুঅঙ্গনা অবশ্য এ সব নিয়ে ভাবেনি। এখনও ভাবছে না। কে মুখাগ্নি করবে তাতে আর বাবার কী এসে যায়! যিনি যাওয়ার তিনি তো চলেই গেলেন। মুখাগ্নি নিয়ে ভেবে আর কী হবে! ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢোকালেই সব শেষ। মুখ, হাত-পা, লাংস, হার্ট সব। নাভিকুণ্ডলী ছাড়া আর কী-ই বা থাকবে!
মামা খবর নিয়ে এল, এ বার পাঁচ নম্বর ঢুকবে। একটা বাচ্চা ছেলের বডি, হার্ডলি আধ ঘণ্টা! এ বার শ্মশানটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা মনে হল সুঅঙ্গনার। গোটা কয়েক নধরকান্তি কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃতরা শুয়ে, জ্যান্তরা ইতিউতি বসে আছে। জ্যাঠামশাই একটা গাছের নীচে বসে আছেন, পাশে সেই ছেলেটি। ছেলেটির কাঁধে জেঠুর হাত। সুঅঙ্গনা কিছুতেই মনে করতে পারছে না, ছেলেটিকে সে কোথায় দেখেছে। ভদ্রমহিলাকে আর দেখা যাচ্ছে না। তিনি কি চলে গেলেন? কে জানে! এত রাতে কার সঙ্গেই বা যাবেন। ছেলেটি তো এখনও আছে। ধুর, এ সব ফালতু কথা ভেবে কী লাভ! কত লোক আসছে, যাচ্ছে। কে কী ভাবে গেল বা এল, সে আর ভেবে কী করবে!
রাজা বলল, ‘চা খাবে?’
সুঅঙ্গনা হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না।
একটা লোক কেটলি হাতে চা বিক্রি করছিল। রাজা তাকে ডাকল। দুটো মাটির ভাঁড়ে চা দিয়ে গেল সে। রাজা আর সুঅঙ্গনা চা খাচ্ছে। এ বার বোধ হয় সময় হয়ে এল। জ্যাঠামশাই উঠলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে এ দিক ও দিকে যারা ছিল, তারাও এক জায়গায় হল আবার। জায়গাটা আবার ভরে গেল মানুষে। জেঠু সুঅঙ্গনাকে বললেন, ‘চলো মা, ডাক এসেছে।’
সুঅঙ্গনা চায়ের ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে উঠে পড়ল।
ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢোকানোর আগে পাটকাঠিতে আগুন জ্বালছেন শ্মশান-পুরোহিত। চার পাশে দাঁড়িয়ে সেই আগুনের রূপ আর তাপ শুষে নিচ্ছে জ্যান্ত বান্ধবেরা। থমথমে মুখ, অনেকটা ভিজে গোবরের মতো। একটু আগেই যারা সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছিল কিংবা হি হি করে আড্ডা মারছিল তারস্বরে, তারাও কেমন পাটকাঠির আগুনে চুপসে গেল সবাই। মুখমণ্ডলে যথাসম্ভব শোক ফুটিয়ে তুলে মৃতের উদ্দেশ্যে তারা দুটো হাত একত্রিত করে নমস্কারের ভঙ্গি করল। শ্মশান-পুরোহিত জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মুখাগ্নি করবে কে? এ দিকে আসুন।’ জ্বলন্ত পাটকাঠিটা তিনি তুলে ধরলেন। জ্যাঠামশাই সেই কিশোরকে এগিয়ে দিলেন শ্মশান-পুরোহিতের দিকে। সুঅঙ্গনা স্পষ্ট দেখতে পেল, ছেলেটির মুখ অনেকটাই বাবার মতো।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|