রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
মননের মন্দির প্যানথিয়ন
রে, অমন করে হাতটা বেরিয়ে আছে কেন?’ ‘মা, বলো না, কার হাত ওটা?’
বলব কী, দুই মেয়ের মতো আমিও তখন অবাক, বাক্যহীন। বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেয়েছি, আধো-অন্ধকারে আধো-আবছায়ায় একটা ছোট কুলুঙ্গির মতো ঘেরা জায়গা, তার মধ্যে এক সমাধি, আর সেই সমাধির উপর প্রাচীন কারুকাজের একটি কাঠের আলমারি (আলমারি? না কি নিচু দরজা-ওয়ালা ঘর?)। আলমারিই হোক আর দরজাই হোক, তাতে দুটি দরজার পাল্লা। পাল্লা দুটি বন্ধ, কিন্তু পুরো বন্ধ নয়। অল্প একটু ফাঁক হয়ে আছে তারা, আর সেই ফাঁকের ভেতর থেকে গলে বেরিয়ে এসেছে একটি হাত! মশাল-ধরা হাত। কী দৃপ্ত ভঙ্গি সেই হাতের! মশাল জ্বালিয়ে কোনও বার্তা জানাচ্ছে সে। আমাদের জন্য।
কী বার্তা? কার হাত ওটা?
এই সেই ইউরোপস্থান-মধ্যবর্তী মহানগরী প্যারিস। আর, প্যারিসের কেন্দ্রভূমির এক কোণে, এই সেই মহান স্থান, যেখানে নীরব গম্ভীর প্রাসাদোপম সৌধে পাশাপাশি রয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি তাঁদের ঘরগুলো। ঘরের পর ঘর, নামের পর নাম। লম্বা লম্বা করিডর দিয়ে এগিয়ে গেলে বড় বড় চারকোণা চক্কর, চার দিক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রশস্ত করিডর, এ পাশে ও পাশে ঘর। প্রতিটি ঘরে শুয়ে রয়েছেন তাঁরা। হ্যাঁ, শুয়ে রয়েছেন।
কারা?
তাঁরা অনেকে। সকলের নাম মনে রাখা কঠিন ব্যাপার। তবে তার মধ্যেও কিছু নাম মনে গেঁথে যাবেই জঁ জাক রুসো, ভলতেয়ার, দেনিস দিদেরো, ভিক্তর উগো, এমিল জোলা, জঁ মুল্যাঁ, আলেকজান্দার দুমা। সভ্যতার মন-দুনিয়া পাল্টে দিয়েছেন যে সব ফরাসি দার্শনিক আর সাহিত্যিক, তাঁদের প্রায় সকলের সঙ্গে এক ধাক্কায় দেখা হয়ে যায় ওখানে গেলেই। দেখা হয়ে যায় কিংবদন্তি ফরাসি বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকদের সঙ্গেও, সে কালের মারি কুরি আর পিয়ের কুরি, কিংবা এ কালের লুই ব্রেল-এর সঙ্গে। এক একটি বিশালাকার কুলুঙ্গি-ঘর নির্ধারিত তাঁদের জন্য, আর পাশে লম্বা সাদা বোর্ডে বড় বড় পোর্ট্রেট ঝুলছে, পাশে তাঁদের নাম ধাম জন্ম কর্মের বিস্তারিত বিবরণ। কুলুঙ্গির মতো ঘরগুলো সব ক’টাই ভর্তি নয় কিন্তু। এত জন সেখানে থাকেন, তবু সৌধের বহু অংশই এখনও খালি। আরও অনেকে আসবেন, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সেরা মনের মানুষগুলি এসে অতীতের সঙ্গে মিলবেন। কয়েক শতাব্দীব্যাপী ব্যাপ্ত জাতীয় গৌরবের অংশ হয়ে যাবেন। জোয়ান অব আর্ক-এর মতো যে সব আইকনের দেহ আরও অনেক পুরনো সময়ে হারিয়ে গিয়েছে, সময়ের ফাঁক গলে ইতিহাসের অতলে গিয়েছে, তাঁরাও আছেন। তাঁদের বিশাল ছবি, তাঁদের জীবন ও কাজের পরিচয় ছড়িয়ে আছে করিডরগুলি জুড়ে।
কেবল সমাধি আর ছবি নয়। আছে আরও অনেক কিছু। বিখ্যাত মানুষের বিখ্যাত কাজের স্মৃতি। সদর দিয়ে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে গম্বুজাকার সৌধের বিরাট উঁচু সিলিং থেকে ঝুলছে একটা সুদীর্ঘ তার, আর সেই তারের নীচে দোদুল্যমান ধাতব পেন্ডুলাম। এই হল সেই সুবিখ্যাত ফুকো-র পেন্ডুলাম। ১৮৫১ সালে ফরাসি পদার্থবিদ লেঅঁ ফুকো এই পেন্ডুলামের সাহায্যে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন। পৃথিবীর আহ্নিক গতি-র যথাযথ পরিমাপ করতে সফল হয়েছিলেন। সেই পেন্ডুলাম আজও এখানে শোভিত। দেড়শো বছর আগে সেই ঐতিহাসিক পরীক্ষাটা ঘটেছিল এইখানে, এই অসামান্য সৌধের অন্দরেই। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কেন এই সৌধ এত বিশিষ্ট। অতীতের, বর্তমানের (এবং ভবিষ্যতের) ফ্রান্সের যত সেরা মনের মানুষ আর তাঁদের যত সেরা কীর্তি, সব নিয়েই তৈরি মননের এই মন্দির, ‘প্যানতেঅঁ’, ইংরেজিতে ‘প্যানথিয়ন’, অভিধানে যার অর্থ ‘এভরি গড’, ঈশ্বরের সমাহার। ফরাসি দেশ মনে করে, মননশীল মানুষরা ঈশ্বরের চেয়ে কিছু কম নন। সেই শ্রেষ্ঠ-জন, যাঁর সৃষ্টিগুণ, কৃষ্টি-গুণ শ্রেষ্ঠ। সেই ঈশ্বরোপম মানুষগুলির মরদেহ ধারণ করে রাখার জন্যই এই স্থান, যার ওপর লেখা আছে Aux Grands Hommes La Patrie Reconnaissante (“To The Great Men: The Grateful Homeland”)। জাতির গৌরব তাঁরা। তাই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ দেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জাতির সেরা মানুষগুলিকে এনে এক ঠাঁই-এ রাখার এমন অভিনব প্রয়াস প্যারিসে শুরু হল কবে থেকে? সে কি আর আজকের কথা? দুই শতকেরও বেশি হয়ে গেছে। আঠারো শতকের শেষ থেকে চলছে ঐতিহ্য রক্ষার এই কাজ। আর তার ফল যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বিস্ময়-স্থাপত্যের শহর প্যারিসের মধ্যেও এই প্যানথিয়ন যেন একেবারে আলাদা, অ-সামান্য। চোখ-ধাঁধানো স্থাপত্যটির সামনে দাঁড়িয়ে উপর-পানে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে আমার অভিভূত মাথাটা হঠাৎ নুয়ে এল। এ কীসের সামনে আজ দাঁড়িয়ে আমি? এ তো কেবল স্থাপত্য-কীর্তি নয়, কেবল রাজা-বাদশার স্মৃতি নয়, আমাদের চির-পরিচিত যুদ্ধ-বিগ্রহ জয়-পরাজয়ের কাহিনি নয়, জাতীয়তা কিংবা রাষ্ট্রিকতার ঝকঝকে প্রচার নয়। তার চেয়ে অনেক বড় কিছু, বেশি কিছু। এ যে সম্পূর্ণ অন্য এক ইতিহাসের উত্তরাধিকার, কয়েক শতকের মননের ইতিহাস। একটা জাতির সযত্ন সশ্রদ্ধ সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে কী অসাধারণ মানস-ঐশ্বর্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে এই একটিমাত্র স্ট্রাকচার। ভেবে গায়ে কাঁপুনি লেগে উঠল সে দিন।
অথচ, কী কাণ্ড, প্যারিস শহরের যে-সব অবশ্যদর্শনীয় বলে জেনেছি অ্যাদ্দিন, সেই তালিকায় তো প্যানথিয়ন ছিল না। প্যারিস হল মিউজিয়ামের শহর, সেখানে কতগুলো এবং কী কী প্রকারের মিউজিয়াম আছে, তার তালিকা করতে বসলে যে কোনও বাঙালি মাথা ঘুরে যাবেই। সেই তালিকারই এক কোণ থেকে বেরিয়েছিল এই সৌধের নাম। আর বেরিয়েছিল বলেই না জেদ ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম, পৌঁছবই প্যানথিয়ন-এ। নেপোলিয়নের সমাধিস্থান দেখতে পারি যদি, রুসো-র সমাধিস্থানও দেখবই। সুতরাং হণ্টন শুরু। হঠাৎ-বৃষ্টির পশলা। হু হু শীতল হাওয়া। তবু থামা নেই।
হণ্টনপথ অবশ্য মোটেই সুদীর্ঘ নয়। নোত্রদাম ক্যাথিড্রাল কিংবা আইফেল টাওয়ার থেকে রওনা হলে পনেরো মিনিটই যথেষ্ট। সিন নদীর পাশে ঐতিহ্যমণ্ডিত সরবোন ইউনিভার্সিটির পিছনে অলিপথ গলিপথ দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎই উঁচুতে দেখা যায় অপূর্ব ভবনের বিশাল গম্বুজ। ফরাসি ঐতিহ্যের স্পর্ধিত অহঙ্কার। ফরাসি ঐতিহ্য? বিদ্রোহ করে উঠল বাঙালি মন। ‘সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট’-এর রুসো, ‘লে মিজারেব্ল’ বা ‘হাঞ্চব্যাক অব নোত্রদাম’-এর ভিক্তর উগো, রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি তত্ত্বের নোবেলজয়ী মারি কুরি: কে বলেছে, এঁরা শুধুই ফরাসিদের? এঁরা আমাদের নন? ‘আমাদের’ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই বিপুল ঐশ্বর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তাই আমার মন জুড়ে তখন একটাই শব্দ: তীর্থদর্শন!
কার হাত ওটা? প্যানথিয়নে রুসো-র সমাধি
একেবারে প্রথম দিন থেকে, সেই ১৭৯১ সাল থেকেই ধর্মকে পিছু হটিয়ে এই সৌধ বা মৌসলিয়ামটিকেঅধিকার করেছিল ‘যুক্তি’। তখনই বোঝা গিয়েছিল, ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে চাইছে সে দিনের যুক্তির ধারা। ঠিক করেছে, চার্চের কবল থেকে বেরিয়ে নিজের মতো উত্তরাধিকার তুলে ধরবে সে পৃথিবীর সামনে। প্যানথিয়ন তো রয়েছে রোমেও। বাস্তবিক, সেটাই তো মধ্য-আঠারো শতকে ফরাসি দেশের বুরবোঁ শাসকদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, প্যারিসেও ওই এক রকম একটা বিশালকায় সৌধ বানানোর জন্য! কিন্তু তফাত ঘটে গেল একটাই। আর সেই তফাতটা দাঁড়াল বিরাট। রোমের যে আদত প্যানথিয়ন, সেটা বহন করে নামজাদা ধর্মীয় যাজকদের স্মৃতি তখনও, এখনও। ফ্রান্সের বুরবোঁ শাসকরাও সেটাই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল আলাদা। ঘটনাচক্রে প্যানথিয়ন তৈরি হতে না হতে ফ্রান্সের আবহাওয়া গেল পাল্টে, যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেল তার রাজনীতিতে আর সমাজে, বুরবোঁ শাসকদের টেনে নামিয়ে দেওয়া হল সিংহাসন থেকে, দেশের ভার নিলেন বিপ্লবীরা, যাঁরা রাজার রাজত্বেও বিশ্বাস রাখেন না, ধর্মের মহত্ত্বেও না। ফলে সম্পূর্ণ উল্টো এক ঐতিহ্য তুলে ধরল প্যারিসের প্যানথিয়ন, যার মধ্যে জায়গা পেলেন চার্চবিরোধী, চার্চ-বিদ্বেষী কিংবা নিদেনপক্ষে চার্চ-নিরপেক্ষ সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী আর দার্শনিকরা! এখানেই ইউরোপের পুরনো ক্যাথলিক ধর্মভীরুতা থেকে রাস্তা পাল্টে ভিন্পথে চলে গেল প্যারিস, দুর্দান্ত বিপ্লবী ইউ-টার্ন নিল সে দিনের ফরাসি ঐতিহ্য।
এই হচ্ছে সে দিনের ফরাসি বিপ্লব। আসল বিপ্লব যদিও শুরু হয় ১৭৮৯ সালে, তার অনেক আগে থেকেই ফ্রান্সে একটা আশ্চর্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটতে শুরু করে দিয়েছিল। সেই বিপ্লব চলছিল উচ্চচিন্তার জগতে। সেখানে তখন একের পর এক বিধ্বংসী রচনা প্রকাশ করে চলেছেন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮), রুসো (১৭১২-১৭৭৮) কিংবা দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪)। এঁদের প্রত্যেকের তত্ত্ব পরবর্তী কালে গোটা দুনিয়াকে নতুন পথ দেখাবে, আজকের একুশ শতকেও তাঁদের রচনার নতুন অর্থ, নতুন বিশ্লেষণ হয়েই চলবে। চার্চের বিরুদ্ধে সে দিন ফুঁসে উঠছিল তাঁদের কলম, রাজা ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ ও তিক্ত ব্যঙ্গ তাঁরা ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন প্যারিস শহরের হাওয়ায় হাওয়ায়। ফরাসিরা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হচ্ছিলেন ভেতরে ভেতরে। নিশ্চয়ই তৈরি হচ্ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা ষোড়শ লুই আর রানি মারি আঁতোয়ানেত-এর শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে গিলোটিনে তাঁদের মুণ্ডচ্ছেদ করতে।
ফরাসি বিপ্লব আসার তিন দশক আগের কথা, তখনও সিংহাসনে মহাপ্রতাপান্বিত সম্রাট পঞ্চদশ লুই, ফরাসি বিপ্লবের সূত্রে যে ষোড়শ লুই-এর কথা আমরা জানি, তাঁর বাবা। পঞ্চদশ লুই-এর খুব কঠিন অসুখ করেছিল সে সময়ে। অসুখ থেকে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে চেয়ে ‘মানত’ করলেন তিনি, প্রতিজ্ঞা করলেন সেরে উঠেই একটা ভাল কাজে হাত দেবেন। সেন্ট জেনেভিয়েভ-এর যে চার্চটি প্যারিসের একেবারে মাঝখানটিতে ভাঙাচোরা হয়ে পড়ে আছে, সেটাকে সারিয়ে তুলবেন, এমন জিনিস তৈরি করবেন যে সে স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ চোখের পলক ফেলতে পারবে না, নিশ্বাস নিতে পারবে না! তার আগেই ভার্সাই-এর অপূর্ব দুনিয়াসেরা প্রাসাদ তৈরি করে ফেলেছেন পঞ্চদশ লুই, সুতরাং তাঁর পক্ষে এ আর কী কঠিন কাজ! শুরু হল পুনর্নির্মাণ ১৭৬৪তে। ঠিক হল, এর নাম হবে প্যানথিয়ন। এতে রাখা হবে বড় বড় ধর্মযাজকদের দেহ ও স্মৃতিচিহ্ন।
স্থপতি জাক জারমেঁ সুফলোর প্রবল নামডাক সে সময়ে। তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হল। কিন্তু কাজটা শেষ হতে না হতেই মারা গেলেন তিনি (১৭৮০)। গুরুর কাজ হাতে তুলে নিলেন শিষ্য জঁ-বাপতিস্ত রঁদলে। সৌধ শেষ হল ১৭৯০ সালে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তো জমানা পাল্টে গেছে, বিপ্লবের ধাক্কায় আড়াইশো বছরের বুরবোঁ সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ, দেশের ভার বিপ্লবীদের ‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্ব্লি’-র হাতে। অ্যাসেম্বলি সেই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তটি নিল: ঠিক করল, রাজা নেই তো কী হয়েছে, নতুন রাষ্ট্রই নেবে প্যানথিয়ন-এর ভার, এবং সেখানে কোনও ধর্মের জায়গা হবে না, কোনও যাজক পুরুতের ঠাঁই হবে না, রাখা হবে কেবল প্রধান চিন্তাবিদদের মরদেহ। ‘দ্য গ্রেট ফ্রেঞ্চমেন’-এর দেহ। কারা সেই ‘গ্রেট ফ্রেঞ্চমেন’? চটপট নিয়ে আসা হল রুসো, ভলতেয়ার, দিদেরো-র মরদেহ, মহাসমারোহে তাঁদের আবার নতুন করে সমাধিস্থ করা হল।
পরের দুশো বছরে কত রকম বাঁক নিয়েছে ইতিহাস। মাঝেমধ্যে পাল্টেছে প্যানথিয়ন-এর মালিকানাও। কখনও প্রতিবিপ্লবীরা সেখানে নিজেদের নায়কদের রেখেছে। কখনও অল্প সময়ের জন্য ধর্মগুরুদেরও আবার সেখানে জায়গা হয়েছে। কিন্তু ১৮৪৮ সালে যে দ্বিতীয় বিপ্লবটি হল, তার পর আর পিছু ফিরে তাকায়নি ফ্রান্স, এবং ফ্রান্সের সঙ্গে প্যানথিয়ন। কোনও ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, কেবল মানবতা। একের পর এক বিজ্ঞানী, শিল্পী, দার্শনিক, সাহিত্যিকদের ধারণ করে কৃষ্টি ও সৃষ্টির গৌরবে দৃপ্ত হয়ে উঠেছে সেই সৌধ। তার তুল্য আর একটিও সমাধি-স্থান আছে কি এই দুনিয়ায়, আজও।?
‘অমন করে হাতটা বেরিয়ে আছে কেন?’ ‘মা, বলো না, কার হাত ওটা?’ সত্যিই তো, আশ্চর্য সাহসী ভঙ্গিতে কোন্ বার্তা জানাচ্ছে ওই মশাল-ধরা হাত?
কার হাত ওটা?
গায়ে-কাঁটা দিয়ে উঠল। হ্যাঁ, এই তো সেই বিখ্যাত জায়গা। কোথায় যেন পড়েছিলাম জঁ জাক রুসোর সমাধির কথা, যেখানে জীবনের প্রশ্নময় চির-চলিষ্ণুতায় খান-খান হয়ে যায় মৃত্যুর শেষতা, স্থিরতা। মশাল-ধরা মুষ্টিবদ্ধ হাত সব মরণকে অর্থহীন করে দেয়। এই তো সেই হাত। যুক্তির হাত। প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন ভাবে সব কিছু মেনে নেওয়াটা যেন ওই বন্ধ দরজার মতো। আর ওই বদ্ধতা থেকে মানুষই পারে বেরিয়ে আসতে, যুক্তির তীব্র শক্তিতে বন্ধ দরজা ঠেলে খুলে দিতে। সত্যি বলতে কী, ওইখানে দাঁড়িয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল, বহু যুগের ও পার থেকে ভেসে আসা স্পর্ধিত যুক্তিবাদের স্রোত সমস্ত অস্তিত্বকে

দিদেরো-র স্মৃতিফলক
কেমন আবিষ্ট করে দিল। মৃত্যু নাকি শেষ? কে বলে শেষ? মৃত্যু কি পারে জীবন যে সব প্রশ্ন তুলে যায় তাকে অর্থহীন করে দিতে? সমাধি-সৌধ থেকে বেরিয়ে থাকা এই যে অবাধ্য হাতখানি, সে কি আজও, এত কাল পরও আমাদের জাগিয়ে রাখছে না? ধাক্কা দিচ্ছে না? ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছে না আরও সামনের দিকে?
কী-ই বা বলি! তাই কন্যাদের দেখিয়ে দিলাম পাশের বোর্ডে ঝুলন্ত সেই বহু-পরিচিত অমোঘ বাণী: “Man is born free, and everywhere he is in chains.” শৃঙ্খল ভাঙতে হবে, হবেই। মানুষের জীবনের যদি একটিও কোনও কাজ থাকে, তবে তা তো এইটাই: বাঁধন কেটে ফেলো, এগিয়ে চলো, কোনও জমিয়ে-রাখা ভারে নিজেকে ভারাক্রান্ত হতে দিয়ো না। রুসোর সমসাময়িক আর এক দার্শনিক ভলতেয়ার যখন বলছিলেন চার্চের কবল থেকে সমাজকে মুক্ত করার কথা, রুসো নিশ্চয়ই তখন মনে মনে হাসছিলেন: এই পর্যন্ত? এইটুকুই? কেবল চার্চের কবল? সমাজের কবল থেকে কে মানুষকে মুক্ত করবে? সাধারণ মানুষকে কে তার প্রাপ্য জায়গা করে দেবে? রাজা-অভিজাত-জমিদার-লাঞ্ছিত এই অসহ অসম সমাজের দমন থেকে রক্ষা করবে কে?
ভলতেয়ার আর রুসোর মধ্যে কেবল মানসিক দূরত্বই ছিল না, তাঁরা পরস্পরকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না বলেই শোনা গেছে। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “It is not surprising that Rousseau and Voltaire ultimately quarreled; the marvel is that they did not quarrel sooner.” অথচ তার পর? মৃত্যুর কী অদ্ভুত সৌন্দর্য। দুই যুযুধান দার্শনিক এসে মিলে গেলেন এখানে, পাশাপাশি। তা তো হতেই হবে, শত মতভেদ সত্ত্বেও পাশেই তো ছিলেন তাঁরা, তাঁরা যে দু’জনেই যুক্তির পথের পথিক, মননের দুর্মর গতির রাশ তাঁদের পাশাপাশি হাতে ধরা! জীবনে যাঁরা সঙ্গী হতে পারেননি, মরণের পরে তাঁদের এই ভাবে পাশাপাশি সঙ্গী করে দেওয়া হল যাঁদের বিচারে, তাঁদের প্রতি ভারী কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল মন।
কৃতজ্ঞ লাগল পিয়ের ও মারি কুরিকে দেখেও। এই পদার্থবিদ-দম্পতি একসঙ্গে গবেষণার কাজ করতেন। হঠাৎই এক পথ-দুর্ঘটনায় ঘোড়ার গাড়ি উল্টে গিয়ে প্রাণ হারালেন পিয়ের কুরি। সেটা ১৯০৬। একা হয়ে পড়লেন মারি। ভেঙে পড়লেন কিছু দিনের জন্য। কিন্তু কাজপাগল মানুষ, ক্রমে ফিরে গেলেন কাজে। অসাধারণ গবেষণা-প্রবাহ চালিয়ে ১৯৩৪ সালে মৃত্যু হল তাঁর। তিন দশকের ব্যবঘানে এল তাঁদের মৃত্যু, কিন্তু সেই দুঃসহ বিচ্ছেদের দূরত্ব দূর করে দিন প্যানথিয়ন। পিয়ের কুরি-র দেহ যেখানে রাখা হয়েছিল, তার ঠিক নীচেই মারি-র জন্য জায়গা আগে থেকেই চিহ্নিত করে রাখা ছিল। আটাশ বছর পর পাশাপাশি শুলেন তাঁরা। আটাশ বছর ধরে এমন ভাবে স্থান ধার্য রাখার কথা ভাবতে পারা, এর মধ্যে কত যত্ন, কত শ্রদ্ধা! কত নীরব সেই যত্ন আর শ্রদ্ধার প্রকাশ!
আসলে, মনে রাখার কাজটা বোধ হয় খুব সহজ নয়।
সমাধির ওপর ভলতেয়ার-এর মূর্তি
প্যানথিয়ন তো এই দুনিয়ায় একটিই, একটিমাত্র। মনসম্পদের উত্তরাধিকারকে এত যত্নে রক্ষা করতে আর কি কোথাও দেখেছি আমরা? দুনিয়ায় এই একটিমাত্র মন্দির, যেখানে দেবতার আরাধনা হয় না, মানবতার আরাধনা হয়!
তার মধ্যেও অবশ্য আলাদা করে মনে পড়ে যায় নিজেদের কথা, একেবারে আমাদের কথা। ফিরতি-পথে ভারী মন খারাপ হয়ে যায়। আমরা হয়তো সমাধি-সৌধের সংস্কৃতি নই, কিন্তু স্মরণের সংস্কৃতিও কি আমাদের নেই? সেটুকুও কেন ভাল ভাবে রপ্ত করতে পারিনি! কেন কখনও ভাবিনি, আমাদের সেরা মননের ইতিহাসকে, সেই ইতিহাসের নায়কদের, সেই নায়কদের স্মৃতিচিহ্নগুলিকে এ ভাবে এক জায়গায় এনে আমাদের এত দিনের গৌরবের আঁচে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে তপ্ত করে তোলার কথা! কত অহঙ্কারই তো সারা ক্ষণ আমাদের ঘিরে রাখে, কত অর্থহীন, কত সাময়িক, কত দীন সে সব অহঙ্কার। অথচ ঐতিহ্যের এই অহঙ্কার কেন আমরা করি না? ঐতিহ্যের অহঙ্কার যে আসলে ঐতিহ্যের প্রতি প্রণতি! এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো ধূপে দীপে ঘোষণায় বাগাড়ম্বরে কি সেই প্রণতি খুঁজে পাওয়া যায়? প্যানথিয়ন-এর মতো এমন আত্ম-প্রদর্শন যদি তৈরি করতে পারতাম আমরা? স্মরণের গৌরব যদি ফুটিয়ে তুলতে পারতাম এমন নিস্তব্ধ কিন্তু বাঙ্ময় সম্ভারে?
First Page Rabibasariyo Golpo


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.