দম মারো দম শেষে ক্যালকুলেটেড বেয়াদপি
ই আমি কখনও নেশা করিনি। মানে নেশা বলতে যা বোঝায়। মদ-সিগারেট-গাঁজা-এল এস ডি-আফিম-কোকেন কিস্যু না। কখনও ঝিম আবেশে বুঁদ হয়ে যাইনি। অথচ বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি যদি নেশা করে বাড়ি ফিরতাম কোনও দিন, আমার বাড়ির লোকেরা বিশেষ অবাক হতেন না। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, আমার হাবভাব-অ্যাটিটিউড দেখে নাকি মনে হত, আমি যা খুশি করতে পারি। লোকজন পেটাতে পারি, ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ঝামেলা করে তার ডেরায় চলে যেতে পারি, কারেন্ট চলে গেলে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইকে হুমকি দিতে পারি, আর সাবালিকা হওয়ার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেই পারি। অতঃ আমার মা নাকি হামেশাই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত, এই আমি জাস্ট জাহান্নমে গেলাম বলে। এ সব কথা অবিশ্যি আমি জানতাম না। অন্তত ডাবল সাবালিকা হওয়ার পর যে দিন দিদির কাছ থেকে মায়ের এই আশঙ্কার কথা জানতে পারলাম, সে দিন নিজের প্রতি একটু মায়া হল। ভাবলাম, আমার এ রকম সুযোগ ছিল, আর জীবনটা নিয়ে একটুও ছিনিমিনি খেললাম না!!!! ইস্স্, বড্ড মিস হয়ে গেল। অতএব কোনও এক মাঝরাতে চোখ লাল-লাল করে, দরজায় হেলান দিয়ে অমিতাভ স্টাইলে বেল বাজিয়ে অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়ালে ইতর-বিশেষ হত না। মা কষ্ট পেত বটে খুব, কিন্তু ভড়কে যেত না।
এ তো গেল আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটের বর্ণনা। কিন্তু ফিরে ফিরে ভাবি, কেন নেশা করলাম না কখনও? লোকে তো এক্সপেরিমেন্ট করতেও এক দিন গাঁজা টানে, এক দিন উত্তাল মদ খেয়ে বন্ধুর বাড়িতে বমি করে পর দিন আপ্রাণ চেষ্টা করে নর্মাল ব্যবহার করতে, আর মা কিংবা দিদি কিংবা ছোট কাকিমা কোনও না কোনও ভাবে ধরে ফেলে। এবং তার পর চলে ইয়্য়া বকুনি পর্ব। সোনার গোপালের পা ছুঁয়ে দিব্যি করতে হয় আমি আর কখনও এমন করব না, করব না, করব না। বাবার মান মায়ের কষ্ট দিদি/বোনের বিয়ে আটকে যাওয়া, কত রকম ইকোয়েশন জড়িয়ে থাকে! এবং এ মেয়ে যে বম্বে পালাবেই এ রকম আশঙ্কায় রইরই করে বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু হয়। অথচ আমি কিচ্ছুটি করলাম না, এই ভেবেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়। বাথরুমের আয়নাটার সামনে দাঁত খিঁচিয়ে নিজেকে বলি, তুই কী ভীতু র্যা...
কিন্তু আমি নেশা করলাম না কেন? মা কষ্ট পাবে বলে? আমার শরীর খারাপ হবে বলে? নেশা করা খারাপ বলে?
নাহ্! এ সব কোনওটাই নয়। আমি নেশা করলাম না, আমার ধক নেই বলে। অল-আউট যেতে পারলাম না বলে। নিজের সঙ্গে নিজের দোস্তি হল না বলে। নিজেকে ঠিক নিজের মতো করে গ্রহণ করতে পারলাম না বলে। এ দিকে কিন্তু বড় বড় বুকনির শেষ নেই। জীবন সম্পর্কিত এমন তার্কিক দর্শন আমি দশ মিনিটের ছোট পুরিয়া আকারে প্রেজেন্ট দিতে পারি, দেখলে মান্যি যাবে লোকে। ভাববে এ মেয়ে যেমন তেমন মেয়ে নয় তো! এত সংবেদনশীল কথাবার্তা বলব, এমন বাঁধনছাড়া জীবনের লেকচার দেব এবং এমন ক্যালকুলেটেড বেয়াদপি করব, যাতে ‘একটু আলাদা’ এ হাততালি বরাদ্দ থাকে।
অথচ নিজে জানি, আমি কত ইমেজ কনশাস, কত ভীতু। আমি নেশা করি না, কারণ আমার ভয় যদি নেশার বশে উল্টোপাল্টা বলে ফেলি? যদি আমার কারুর প্রতি আর্কষণ বা অপ্রিয় মনোভাব বেরিয়ে আসে, যদি নেশা করেছি বলে আমায় কেউ খারাপ ভাবে? আমি আসলে নিজেকে নিজের কন্ট্রোল থেকে মুক্ত করতে পারি না। অপারেশন টেবিলে প্রাণপণ চেষ্টা করি যত ক্ষণ জাগ্রত থাকা যায়। জীবনের এতটা সময় আমার অগোচর হয়ে যাবে, এই ভাবনায় হাত-পা সেঁধিয়ে যায় পেটে। I just can’t let go of myself. আমি আসলে সেই মেয়েটাই, যে সামাজিক নিয়মে বাঁধা। যে প্রবন্ধে আর সচেতনতায় সমাজকে গালাগাল দেয়, কিন্তু নিজের ব্যবহার দিয়ে কখনও সমাজকে অস্বীকার করতে পারে না। কখনও বলতে পারে না, বেশ করেছি, আরও করব। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেকে নিয়ে কমফর্টেবল নই। আমি সব সময় ভেবেছি, এ রকম করলে যদি কেউ কিছু বলে, যদি কেউ দোষ দেয়, আমি যদি আমার সেট করা মাপকাঠি থেকে নীচে নেমে যাই। অথচ যারা এ সব ফুৎকারে উড়িয়ে নেশা করতে পেরেছে, তারা বলেছে, ‘কী হবে? বকুনি খাব? লোকে খারাপ ভাববে? দু-দিন শরীর খারাপ হবে? তাতে কী? আমি তো আমার মতো করে বাঁচব।’
আমি যে ভাল ও খারাপের মিশ্রণ এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। আমি জেনেছি, আমার যে কোনও কাজে লোকে ওয়া ওয়া করে উঠবে, এটাই নাকি নিয়ম। এ হেন মেয়ে আমি কি যেমনতেমন কাজ করতে পারি? আমি বেল্লেলাপনা করলে, নিজের চোখে খারাপ হয়ে যাব যে। তখন আমি রুটিনচ্যুত, যে রুটিন আমার ঘ্যানঘেনে জীবনকে আলোকিত করে। মুখে বলি, রুটিন নিপাত যাও, আর অবচেতনে যাহা কিছু রুটিনৌচিত্য তাহাকেই জড়িয়ে ধরি। এই অ-স্বাধীনতা বড় সোয়াস্তি দেয়। নেশা করে যদি আমায় নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়! যদি সাইকেডেলিক তূরীয় দুনিয়ায় আমি দেখতে পাই আসলে আমার ভেতরেও একটা আস্ত ক্রিমিনাল আছে! তার চেয়ে কী দরকার বাবা, যেমন আছি তেমনি থাকি। টইটম্বুর জীবন উপভোগ করার জন্য নিজের সেন্স বিসর্জন দিতে হবে কে বলেছে?
কিন্তু আমি তো জানি, এটাই আমার দুর্বলতা। স্কাইডাইভিং, বাঞ্জি জাম্পিং, প্যারাগ্লাইডিং করার আগে অনিশ্চয়তার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে যে ভয় করে, নেশার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে ঠিক একই ভয়। আমি তো নেশাকে কন্ট্রোল করব না, নেশা আমাকে কন্ট্রোল করবে, আর আমার চরিত্রের বা দুশ্চরিত্রের অস্তিত্বটি গচ্ছিত থাকবে তার কাছে। অতএব এত কষ্ট করে বানানো ইমেজখানা ঠস করে হাত থেকে স্লিপ খেয়ে বেরিয়ে যাবে, এ মানব কেমনে? মুখে বলেছি আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই, আর বেঁচেছি ঠিক অন্যে যা চেয়েছে। আমার সামনে যারা মাতলামি করে, যারা গাঁজা খেয়ে নাচতে থাকে, যারা এল এস ডি খেয়ে মিটিমিটি হাসে আমি কোথাও তাদের হিংসে করি। ওরা হ্যান্ডস ডাউন জিতে গেছে। ওরা আগের রাতে বন্ধুর গায়ে বমি করে পরের দিন, ‘ভুল হয়ে গেছে বস’ বলে জড়িয়ে ধরতে পারে। নিজেকে নিয়ে ওরা কর্মফটেবল। নিজের কাছে সর্বক্ষণ ওরা জবাবদিহি করে না। নিজের কাছে ‘পারফেক্ট’ হওয়ার দাসখত লেখেনি ওরা। নিজেদের যা খুশি করার স্বাধীনতাটা অ্যালাও করতে পেরেছে, সব বাঁধন থেকে মুক্ত করতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের সাহস আর দুর্বলতা, নিজের ভাল আর খারাপকে নিয়ে সহবাস করছে।
ওদের ঘরে কে কে বসত করে, ওরা জানে। আমি জানি না।
Previous Item Utsav Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.