|
|
|
|
জিভ ছুঁয়ে ছোবল |
আমার প্রতিবাদের ভাষা কিংবা আমার আত্মার আরাম আমি ছাড়া এই আবাহন আর বিসর্জন
কেউ জানে না। ব্রাউন সুগার এল এস ডি’দের সঙ্গে কিছু বছর। দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত |
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে
দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ
ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়...
আমার ভাব-ভাবনার জন্মলগ্ন থেকে এ ছিল রোজনামচা। মধ্যরাতে বাড়ি ফেরার সময় পাড়ার চৌকিদার সরে দাঁড়াত। কুকুরগুলোও ঘেউঘেউ ভুলে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকত, আমরা ফাইভ-ম্যান আর্মি’র নায়কদের মতো বীরদর্পে পাড়ায় ঢুকতাম। কেউ কথায় কথায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে তুষার রায় গড়গড় করে বলছে, কেউ বা যাবে কানপুর আই আই টি, কেউ বা ভিনু মানকড় ট্রফির ম্যান অব দ্য ম্যাচ এমন পাঁচরত্নের পা যদি মাঝরাতে টলমলও করে, সেটা তখন biodata-তে extra curriculum activities-এ লিখে দেওয়া যায়। এই সময়ই শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এক নতুন নেশা, ব্রাউন সুগার। দূরদর্শনে অমিতাভ বচ্চনের সতর্কবাণী সমৃদ্ধ ‘সুবাহ’ সিরিয়াল কাজে এল না, উল্টে নতুন পথে চলতে চেয়ে অনেকেই তখন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান। গোড়ার দিকে আধা চামচ ফ্রি দেওয়া হত। দু’এক দিন। তার পর ফেল কড়ি মাখো তেল। রিপন স্ট্রিট, পার্ক লেন, চাঁদনি চকের গুমঘর লেন, লালবাজারের সামনে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর কলাবাগান, ও দিকে তপসিয়া, ট্যাংরা, গোবরঝুরি মাঠ, আক্রা, সন্তোষপুর, ঘুটিয়ারি শরিফ সব জায়গায় হেরোইন মানেই ক্ষুদ্র কুটির শিল্প। উচ্চবিত্তদের স্টাইল স্টেটমেন্ট দু’দিনেই হয়ে গেল আমাদের নেশা, মধ্যবিত্তদের বিপ্লব।
বম্বে থেকে সন্দীপ কলকাতায় আসে ’৯৩ সালে। এখানকার হেরোইনে নাকি টেম্পার কম, টার্কি কাটতেই চায় না। বাড়ির লোক ভর্তি করে দিল নার্সিংহোমে, ১৫ দিনের detox, দেওয়া হল প্রচুর ইঞ্জেকশনের ককটেল। প্রথম সাত দিন সে ঘুমিয়ে কাটাল, বাকি আট দিন ঘুম আর খাওয়া। ওজন বাড়ল, বাড়ির লোক নিয়ে গেল বাড়ি। এর পর সন্দীপ ঘুরে বেড়ায় ওষুধের দোকানে দোকানে। এমনকী হাজরা রোডের ওষুধ কারখানার গেট থেকে কর্মীরাই ঘড়ি ধরে ‘পেথিড্রিন’ ইঞ্জেকশন বেচে যেত। আর শহরের হাজার ওষুধের দোকান বিনা প্রেসক্রিপশনে দিয়ে দিত মরফিন গ্রুপের ইঞ্জেকশন। এ সবের রমরমা শহরতলিতে, দামও কম। মেহেতা বিল্ডিং থেকেও পাইকারি দরে কিনেছে বহু বার।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত আর টলমল করে না। এখন সময় এল শুধুই মাথা টলমল করার। আর এর পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ওই ওষুধের দোকানগুলির। M-10 যদি মারাদোনা আর তাঁর জার্সি নম্বর হয়, এর কাছাকাছি লেটার-এ আছে অজস্র ঘুমের ওষুধ। অ্যান্টাসিডের মতো নাকি চুষে খেতে হয়। ফেনারগান যেন রেস্তোরাঁ’র মৌরি। শরীরে অযথা ঢুকে যাচ্ছে অ্যালার্জি’র ইঞ্জেকশন। সবই নেশার জন্যে। আমি ভাবি আমার মাথা ছাড়া ঢুলুনি কেউ বোঝে না। বোঝা যায়, আবার কখনও যায়ও না। মেয়েরা নির্দিষ্ট সময়ের যন্ত্রণা ভুলতে স্প্যাজমোপ্রক্সিভন খাওয়া শুরু করে। একটা নির্দিষ্ট সময় হয়ে যায় রোজকার অভ্যেস। আর তার পরেই ৩০ দিনের যন্ত্রণা, যদি ওটা না খাওয়া হয়। কোনও কোনও মহিলার রুটিনে ঢুকে পড়ল ‘ফোর্টউইন’ ইঞ্জেকশনও। |
|
যাবতীয় বাদীদের বিতর্ক সরিয়ে ছেলেমেয়ের বিভাজনটাও কমে গেল। ঢাকুরিয়া রেল বস্তি, কলুটোলায় সারা দিন কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের আনাগোনা। বৃহস্পতিবার মাজারে বসলে ‘বাবা’র (পড়ুন গাঁজা) উগ্র গন্ধে আজও মশা কামড়ায় না। কলকাতা পুরসভার মূল ভবনের এক দিকের ফুটপাথে আজও প্রকাশ্যে কনুইতে দড়ি বেঁধে এ ওকে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছে, নিডল ধুচ্ছে, চাদরে আপাদমস্তক মুড়ে তিন-চার জন রোজ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ওপরে বসে ‘পাত্তা’ খায়। আজও শহরের অলিতে-গলিতে ডিটক্স আর রিহ্যাব সেন্টারের রমরমা। সুস্থ জীবনে ফেরাবার প্রচেষ্টা অনেক হয়, কিন্তু সেটা তাদের জন্যেই যাদের ব্যাক-আপ আছে।
আজ আমরা সেই পাঁচ বন্ধু, ছড়িয়ে গিয়েছি পাঁচ জায়গায়। নেশা নেই, তবে দেখা হলে সেই নেশাই তখন নস্টালজিয়া। খবর পাই পুরনো যা যা ছিল, সবই আছে সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও নতুন নতুন কিছু উপায়। আমাদের সময় ট্রিটমেন্টের জন্য নাগাল্যান্ড থেকে আসত কিছু ছেলে, তাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছিলাম টিকটিকির ল্যাজ পুড়িয়ে খাওয়ার কৌশল। ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সহ LSD ট্রিপটাও তখন শেষ। সাপের ছোবলটাও আজ থেকে ২৫ বছর আগে ব্যাক-ডেটেড। শুনতাম বড়বাজারে পাওয়া যায়। কোনও সাপের বিষ তোলার প্রথম তিন-চার দিনের মধ্যেই নাকি নিয়ে নিতে হয় ওই ছোবল। হাঁড়ির জানলা সরিয়ে শুধু জিভ ঢুকিয়ে দেওয়া... চাক্ষুষ করিনি।
এর পর হইহই করে এল নানা উদ্ভট আয়োজনের নেশা। কেউ কোথাও কোডিটল গুঁড়ো করে স্নিফ করছে, তো শান্তিনিকেতনের চায়ের দোকানে বসে কেউ এক চুমুকে এক শিশি কাফ সিরাপ শেষ করেই চা খাচ্ছে। প্রায় সবাই ছাত্রছাত্রী। বনগাঁ, সল্টলেক-এ দেখেছি পাউরুটির মাঝখানে ব্যথার মলম মাখিয়ে খাচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। ন্যাকড়ায় পেট্রল কিংবা কেরোসিন চুবিয়ে শোঁকা।
অ্যাডহেসিভের গন্ধ টানা হালফিলের ফ্যাশন থেকে নেশা। সর্দি থেকে আরাম পেতে নেজাল ড্রপও তা-ই। টলিউডের সাম্প্রতিক সংযোজন। না নিলে তারা সবাই নাকি ভৌতিক সুরে কথা বলবে। শুধু নেশা নয়, সাধ করে খেয়ে আর বন্ধ করতে না-পারার তালিকাতেও কিছু ওষুধ ঢুকে গেছে। পরবর্তী সময়ে যার ফল মারাত্মক। তবু নিজেকে আর একটু যুবতী দেখাতে অনেকেই ডেকাডেন খাওয়ার অভ্যেস থেকে বেরোতে পারেনি। আমার চেনা ক্লাস টেনের মধুমিতা প্রথমে পিরিয়ডের সমস্যা থেকে এখন কিডনির অসুখে ভুগছে। ক্লাস সেভেন থেকে পড়ার সময় নাকে রুমাল চেপে রাখত, কে জানত তা হোয়াইটনারে ভেজা?
আগে তবু পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করত। ধরা পড়লে হয় বেদম মার, নয় ‘উচ্ছন্নে যাও’। এখন বুঝতে পারার আগেই সর্বনাশ হয়ে যায়। আমরা পাঁচ বন্ধু ভাগ্যিস নেশার বাইরে! তাই, নস্টালজিয়া থাকলেও দূরে দাঁড়িয়ে আজ আমরাও বুঝে পাই না এ জীবনের নেশা, না কি নেশার জীবন? |
|
ডাকনাম: এল এস ডি |
১৯৪৩।
সুইটজারল্যান্ডে নামজাদা ওষুধ কোম্পানির গবেষণাগারে শ্বাসকষ্টের ওষুধ তৈরি করেছেন অ্যালবার্ট হফম্যান। ঠিক করলেন, নিজের ওপর পরীক্ষা করবেন। খেলেন, ২৫০ মাইক্রোগ্রাম, মানে এক গ্রামের চার হাজার ভাগ। এক ঘণ্টার মধ্যে শরীর জুড়ে আশ্চর্য সব অনুভূতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেটা, গাড়ি নেই। একটা সাইকেলে চড়িয়ে তাঁকে বাড়ি নিয়ে গেলেন সহকর্মী। যেতে যেতেই মনের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, মনে হল তাঁর প্রতিবেশী আসলে এক ভয়ঙ্কর ডাইনি, ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল, এবং তারই মধ্যে এক বার মনে হল ওষুধটা নিশ্চয়ই ভয়ানক বিষ, তিনি আর বাঁচবেন না। ডাক্তার ডাকা হল, তিনি পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কিছুই পেলেন না, কেবল চোখের মণি দুটো এমন বড় হয়ে গেছে যে, দেখে ডাক্তারেরও তথৈবচ। তার পর? অ্যালবার্ট পরে লিখেছিলেন, “আস্তে আস্তে মনটা অদ্ভুত ফুরফুরে হয়ে গেল, চোখ বন্ধ করলেই আশ্চর্য সব রঙের খেলা, অকল্পনীয় নকশা, মুহূর্তে মুহূর্তে পালটে যাচ্ছে, রং বদলাচ্ছে, জ্বলছে নিভছে...” অ্যালবার্ট হফম্যান-এর উদ্ভাবিত ওষুধটির নাম লাইসারজিক অ্যাসিড ডাইথাইলামাইট। তবে ও নাম কেবল বিজ্ঞানীদের জন্য। ডাকনাম সকলের চেনা: এল এস ডি। উত্তাল ষাটের দশকে নেশার নতুন দুনিয়া তৈরি করে দেবে এই আশ্চর্য রসায়ন। |
|
|
|
|
|