সোমরস ও সেই সব মদালসা
কেন যে লোকে নিন্দা করার জন্য ‘মাতাল’, ‘গেঁজেল’ এই সব বলে! অর্বাচীনরা বোঝে না, মদ এবং গাঁজা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। আজ নয়, সেই ঋগ্বেদের আমল থেকে এই সব চলে আসছে।
প্রথমে সোমরস। ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের ৪৭ নম্বর সূক্ত: ‘এই সোম পীত হইয়া আমার বাক্যের স্ফূর্তি বিধান করিতেছে। ইহা অভিলষিত বুদ্ধি প্রদান করিতেছে।’ কী সহজসরল বাস্তব অনুভূতি!
কিন্তু সোমরস জিনিসটা ঠিক কী? সম্ভবত আফগানিস্থান, পাকিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চলে ‘এফিড্রা সিনিকা’ নামের এক লতা। কিন্তু পণ্ডিতেরা এখনও নিশ্চিত নন। আপাতত, তাঁদের ওই ব্যর্থতার জন্যই আমরা যথার্থ সোমপান করতে পারি না, রাম, হুইস্কি আর কালী মার্কাতেই তৃপ্ত থাকতে হয়।
চাঁদনি রাতে এই লতাটাকে মূলসুদ্ধু উপড়ে, ছাগলে-টানা গাড়িতে নিয়ে আসা হত যজ্ঞস্থানে। আমাদের চেনা ব্যা-ব্যা করা ছাগল নয়। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আফগানিস্থানের তাগড়াই পাহাড়ি ছাগল।
যজ্ঞস্থলে আগে থেকেই ঘাস আর কাঠকুটো দিয়ে একটা জায়গা করা থাকত। সেখানে ওই সোমলতাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পাথরে পেষা হত। তার পর ওই পিষে-যাওয়া লতাগুল্মকে পশমের ছাঁকনিতে রেখে দশ আঙুলে চটকানো হত। আর্যরা যথার্থ ‘কনয়সিয়র’ ছিলেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৯৪ নম্বর সূক্তে সোমলতা পেষাই করার পাথরগুলির প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁরা, ‘এই অবিনাশী প্রস্তরদিগের গুণকীর্তন কর। দশ আঙুল যখন সোমরস নিষ্পীড়ন করার সময় এদের স্পর্শ করে, পাথরটাকে মনে হয় দ্রুতগামী ঘোড়া। দশটি রজ্জু তাদের টেনে নিয়ে চলেছে।’
পাথরে ছেঁচা, ঈষৎ হলুদরঙা ওই রস এ বার দুধে মিশিয়ে টানা ৯ দিন ধরে গাঁজানো হত। তার পরই তৈরি হত দেবভোগ্য সোমরস। আর কত যে সযত্নে রাখা হত তাকে! কাঠের পাত্রকে বলা হত ‘গ্রহ’। আর মাটির পাত্রকে ‘স্থালী’। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা... তিন বার সোম নিষ্কাশন করা হত। কে ক’বার টানবেন, তারও নিয়ম ছিল। যজমানেরা শুধু সন্ধ্যাবেলায়। আর যজ্ঞের পুরোহিত বা ঋত্বিকেরা তিন বারই!
ছবি: সুমন চৌধুরী
ঋত্বিকদের কী আর দোষ? বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ প্রমুখ মুনিঋষিদের আশ্রমেও মদের ভাল সাপ্লাই ছিল। রামায়ণে ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে অতিথিরা এসে হাজির। ভরদ্বাজ বললেন, “আমি ইন্দ্রাদি তিন লোকপালকে আহ্বান করিতেছি, তাঁহারা আমার অতিথি সৎকারের ইচ্ছাপূরণ করুন। মৈরেয় মদ্য এবং সুসংস্কৃত সুরা প্রবাহিত করিতে থাকুন।”
মেয়েরাও কম যেত না। বনবাসকালে রামচন্দ্র সীতাকে নিয়েই মৈরেয় মদ্য পান করেছেন। ভরদ্বাজের আশ্রম থেকে বেরিয়ে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা চিত্রকূট পর্বতের দিকে যাচ্ছেন। মাঝে ভেলায় করে যমুনা নদী পেরোতে পেরোতে মা জানকী দিব্যি দিলেন, ১৪ বছর পর ভালয় ভালয় অযোধ্যা ফিরে এলে পুজো দেবেন। ১০০টা গরু আর হাজার ঘড়া মদ দিয়ে। সুরাঘটসহস্রেণ!
শুধু সীতা? মহাভারতে আদিপর্বের শেষ দিকে মদালসা দ্রৌপদী আর সুভদ্রার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন ব্যাসদেব। কৃষ্ণ, অর্জুন, দ্রৌপদী, সুভদ্রা তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এক বার যমুনার ধারে পিকনিকে গিয়েছেন। একটু পরে এখানেই অগ্নিদেব কৃষ্ণ আর অর্জুনের কাছে আসবেন, খাণ্ডবদাহন ঘটবে। কিন্তু দিনের শুরুতে, যমুনাতটে? কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রায় নিরামিষ ঢঙে জানান, ‘দ্রৌপদী ও সুভদ্রা বিচিত্র বসন ও নানাবিধ অলঙ্কার কামিনীগণকে প্রদান করিলেন।’
কিন্তু সেটি  ঘটনা নয়। বিবেক দেবরায় সম্প্রতি মহাভারতের প্রামাণ্য সংস্করণের ইংরেজি অনুবাদে আসল কেচ্ছাটি ফাঁস করে দিয়েছেন, ‘...expensive food and drinks were spread out. In great intoxication, Droupadi and Subhadra gave away expensive garments and ornaments to the women.’ মত্ত মেয়েরা কেউ তখন গদগদ স্বরে কথা বলছে, কেউ বা নির্জন স্থানে সখীর সঙ্গে গোপন আলোচনা সারছে, কেউ বা অহেতুক ঝগড়া করছে।
আর শুধু দ্রৌপদী, সুভদ্রা কেন? বিরাট রাজার পত্নী সুদেষ্ণা জলের বদলে মদ্যপান করতেই ভালবাসতেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে অভিমন্যুর শবদেহ আঁকড়ে পড়ে আছেন তাঁর বালিকা স্ত্রী উত্তরা। সখেদে গান্ধারী বললেন, “মাধ্বীকের মত্ততায় মূর্চ্ছিত হয়েও যে উত্তরা স্বামীকে আলিঙ্গন করতে লজ্জা পেত, হায়, সে আজ সকলের চোখের সামনে পতির অঙ্গ পরিমার্জনা করছে।”
এখানেই প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্য। পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও সমান তালে মদ্যপান করতেন। কোনও বিধিনিষেধ বা জড়তা ছিল না। ‘কুমারসম্ভব’-এ হরপার্বতীর বিয়ে দেখতে মেয়েরা জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘রঘুবংশম্’-এও অজ-ইন্দুমতীর বিয়ে দেখতে মেয়েরা জানলায়। দুটি কাব্যেই কালিদাস উপমা দেন, ‘ভাসাং মুখৈরাসব গন্ধ-গর্ভৈব্যাপ্তান্তরাঃ।’ গবাক্ষগুলি পুরসুন্দরীদের আসবগন্ধমধুর স্বাদ পরম্পরায় ভরিয়া গেল।
কেন মেয়েদের মদ্যপানে ছিল না বিধিনিষেধ? এর উত্তর রয়েছে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’র দশম অধ্যায়ে। মুনিবরের টিপ্স: পুরুষ নারীকে আহ্বান করে মদ দেবেন। তার পর তার চুলে বিলি কেটে দেবেন, আলিঙ্গন করবেন। মদের যে কত গুণ!
মহাকাব্যে মদ যে কত! ‘ওয়াইন’কে বলা হত আসব। আঙুরের রস থেকে ‘দ্রাক্ষাসব’, ফুলের মধু থেকে ‘পুষ্পাসব’, কত ভ্যারাইটি! মধু থেকে তৈরি হত ‘মাধ্বী’। গম বা যব থেকে হত বিয়ার জাতীয় ‘পৈষ্টী’ এবং ‘মেদক’। আর বিশেষ মশলাযোগে আজকের ‘ফর্টিফায়েড ওয়াইন’-এর মতো তৈরি হত ‘অরিষ্ট’ এবং ‘মৈরেয়’। মৈরেয় খাসা জিনিস, ভরদ্বাজ তাঁর অতিথিদের দিয়েছিলেন।
মদ কিন্তু শিবের অঙ্গজ হওয়ার সম্মান পায়নি! অমৃত নিয়ে সুর আর অসুরে তখন কাড়াকাড়ি। অবশেষে দেবতাদের কাছে অমৃত এল। শিব নিজের অঙ্গনিঃসৃত এক লতায় শোধন করে নিলেন সেই অমৃত। অথর্ববেদে তাই পাঁচটি পুণ্য উদ্ভিদের একটি হল গাঁজাগাছ।
ঋগ্বেদের সোমলতা চেনা গেল না ঠিকই, কিন্তু অথর্ববেদের গাঁজাটুকু তো রয়েছে। থাকে নেশা, মারে কে!
First Page Utsav Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.