|
|
|
|
পকেট অবধি পৌঁছে টালমাটাল |
এই মুহূর্তে ঝিমঝিম অস্তিত্ব, পর ক্ষণেই বিস্ফোরণ। তিন দিনের দিনঅলক্ষ্যেই মৃত্যুবরণ। কপিবুক রকস্টার।
প্রথম থেকে শেষ, তাঁদের সঙ্গে, এক মাত্র ড্রাগ। ওভারডোজ। উন্মাদনা। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
একটা ঝাপসা, অসংলগ্ন, অস্থির কিন্তু বেধড়ক ঝলমলে ছবি’র ট্রেন নেচে বেড়াচ্ছে অস্তিত্বের সামনে, কানে তখন হয়তো আদিম খুরের শব্দ, মন কুড়ে খাচ্ছে ছোটবেলায় দেখা রাস্তার ধারের সেই বীভৎস অ্যাক্সিডেন্ট, আবার একই নিশ্বাসে ইচ্ছে পাচ্ছে আকস্মিক যৌন-ঝড়...কিছু মুহূর্ত এমনই ভাসা আর তার পর এক সময় অনন্ত গিঁট খুলে সরল হয়ে যেত, পোয়েট্রি লেখা পাতা পাশে ফড়ফড়াত, হার্টবিট কখন কে জানে দপ করে নিভে গিয়েছে।
আমি রকস্টার।
পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা সারা শহর জুড়ে, চোখের জল আর মুঠোয় ফুল আটকে সারি সারি মন, এক লাইনে। কারও কিন্তু মনে হচ্ছে না, কেন এমন হল, মনে হচ্ছে, আজকের সকালেই কেন এমন হতে হল, মন তো জানেই, এটা হওয়ার ছিল। |
|
‘দ্য ডোর্স’ ফিল্মে জিম মরিসন’এর ভূমিকায় ভ্যাল কিলমার |
পশ্চিমে, রক মিউজিক এমন মৃত্যু দেখেছে অনেক দিন ধরেই। জিম মরিসন বলুন, বা কার্ট কোবেন বা গিটার-ঈশ্বর জিমি হেন্ড্রিক্স, প্রত্যেকের হার্টবিট থামিয়ে দিয়েছে ড্রাগ ওভারডোজ। নানা রকমের। এল এস ডি, এক্সট্যাসি, মারিয়ুয়ানা, ডি এম টি, হেরোইন, আরও বলে যান না। মৃত্যু তো অনেক পরের কথা, নার্কোটিক ড্রাগ্স তো এঁদের শয্যাসঙ্গী ছিল প্রায়। ভুল বললাম, শয্যাসঙ্গীও তো বদলানো যায় (এঁরা বদলেছেন), কোনও এক সময় তাদের থেকেও তো একলা হওয়া যায় (এঁরা পেরেছেন), কিন্তু এই ড্রাগদের কাছছাড়া করতে গেলেই মা খোয়ানোর শোকে কেঁদেছেন। লাখ লাখ চিৎকার ঘেরা স্টেজে দাঁড়ানো মাত্রই যাঁদের গা দিয়ে দেবতার আলো ছড়িয়ে পড়ত, তাঁরাই কি না ঘরের অন্ধকার কোণে এমন নিস্তেজ? কিছুটা কোকেন-ছোঁয়া পেতে অমন হাঁটু গেড়ে করুণ আর্তি? আজব, না?
না। যদি একটু মন দিয়ে এঁদের জীবনে ঢোকেন। ড্রাগ, অ্যাডিক্টদের নিয়ে কী ভাবে খেলে, সে তো ভালই জানা, কিন্তু মরিসন, কোবেন, জ্যানিস জ পলিন বা হেন্ড্রিক্স ড্রাগ নিয়ে কী ভাবে খেলতেন, সেটা বেশ চমকপ্রদ। ব্যাপারটা ক্যারাম হলে বলা যায়, এঁরা ড্রাগকে স্ট্রাইকার করে নিজের ঘুঁটি নিজেরাই মারতেন, সে ঘুঁটি পকেট অবধি পৌঁছে টালমাটাল টালমাটাল। ওইখানেই তো আনন্দ। একটা দিশেহারা অবস্থার মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি ছ’লাইন সুর বা কবিতা প্লাস আর চার অক্ষর। মরিসন-এর প্রিয় খেলা ছিল এটা, নিটশে-র কথা মতো তিনি নিজেকে গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাস ও অ্যাপোলোর মাঝ-অঞ্চলে ফেলতেন প্রায়ই। নিজেই হয়ে উঠতেন গ্রিক ট্র্যাজেডি। অ্যাপোলো দেখাত তাঁকে স্বপ্ন, কিন্তু সে স্বপ্নের মধ্যে কোনও লোভ থাকত না, থাকত যুক্তি, সংযমের ইস্তেহারও। কিন্তু ডায়োনিসাস মরিসনকে আনত অনাবৃত উন্মাদনার আঙিনায়। যেখান থেকে বারে বারে রি-হ্যাব, মৃত্যুর দোরগোড়া অবধারিত। কিন্তু এঁরা জানতেন বোধ হয় ড্রাগ এক বারে মারে না। প্রথম কয়েক বার ফিরিয়ে আনে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর থেকে। তার পর আবার ওই ছোঁয়াছুঁয়ি শুরু। হিশি হয়ে যাবে বিছানায়, পেট নিষ্ঠুর জ্বলবে, বমিতে বমিতে নিজের শ্বাসনলি আটক হয়ে যাবে, তবুও হাত অন্ধের মতো হাতড়াবে টেবিলে কোকেন বা আর যা সব। এমনই সম্মোহনী তেজ তার।
সেই সম্মোহন এঁরাই ফিরিয়ে দিতেন দর্শকের উপর। সে দর্শকও সম্মোহন নিতে এক পায়ে খাড়া। তারাও তো চাইছে ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে অন্য এক স্তরে। কোথায় সেই স্তর? মনে। মনে। কে নিয়ে যাবে? ওই যে, আমার ঈশ্বর, এখন স্টেজে আর আমি আমার হাতে এল এস ডি। স্টেজ থেকে গড়িয়ে নামছে এক রকম ঘোর, পায়ে শেকল বাঁধবে, তার পর তো মরিসন, কোবেন বা হেন্ড্রিক্স বাঁশিওয়ালা, বাকিরা ঝাঁপ দেওয়ার কম্যান্ড-প্রার্থী ষাট-সত্তরের সাইকেডেলিক যুগ।
হেন্ড্রিক্স যখন স্টেজে উঠে গিটারের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতেন বা সেটির উপর পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতেন, তখন সেটা এক রকম ঘোরের মধ্যে থেকেই করতেন। যে ঘোরে, ওই গিটারই তাঁর সঙ্গী, আনন্দের পার্টনার, রাগের অবজেক্ট। আমজনতা ড্রাগ-অ্যাডিক্টের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখানেই, তিনি নেশা করতেন না, নেশা পরবর্তী স্তরেই বাঁচতেন। সৃষ্টি সেখানেই হত, এক সময় অন্ত-ও তথায়। |
|
এখন শুনি, রক গাইতে বা শুনতে হলে নাকি ড্রাগ নিতেই হবে। না হলে আসল রসেই বঞ্চিত। জানি না এ সবের যুক্তি, তক্কো, বৈধতা। শুধু বুঝি মরিসন, কোবেন, হেন্ড্রিক্স-এর ধোঁয়ার পাক বা তাল চারটি কোকেন-টানে ধরা যায় না। অধ্যাবসায় থাকতে হয়। না, নেশার পক্ষে আমি নেই, শুধু বলছিলাম, এই ‘২৭ ক্লাব’-এর ছোঁয়াচ পেতে হলে ওঁদের মনটা আগে বাঁচতে হবে। এঁদের ‘ফরএভার ২৭ ক্লাব’ বলা হত, জানেন? প্রত্যেকেই ২৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন যে। আগে বলেছি ড্রাগ ওভারডোজে, শুধরে নিচ্ছি। ড্রাগের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক ছিল সমানে সমানে, কোনও উপর-নীচ নেই, টেনশন নেই, দু’জনেই একে অপরকে রাখঢাকহীন চিনেছিল, এক দিন এক জন জাস্ট উঠে বেরিয়ে গেল। ব্যস। |
|
|
|
|
|