হাঁড়ির খবর
স্মৃতির রসনা
খন মানুষ এত ব্যস্ত যে ধীরেসুস্থে খাওয়ার সময় কোথায়? তবু এখন শুনি অনেক বাড়িতে ছুটির দিনে পুরনো দিনের রান্না খাওয়ার চল হয়েছে। মা-কাকিমা বা শাশুড়িমায়ের হাতের তরিতরকারির একটা আলাদা স্বাদ তো আছেই। সেটা হল স্নেহের ও আন্তরিকতার।
আজ এতটা বয়সে সেই সব ভুলে যাওয়া স্বাদের এক একটি পদ রান্না করি। কিন্তু সেই মানুষেরা এখন নেই। রান্নার তারিফ করবেই বা কে? যেমন আমার শ্বশুরমশাই চন্দ্রনাথ দাঁ। ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন। বেশ ধীরেসুস্থে একটু বেলার দিকে বেরোতেন। তাঁর একটা প্রিয় পদের কথা বলি। ডিমের ধোঁকা। সমান সংখ্যক আলু ও ডিম নিতে হবে। আলু সেদ্ধ করে চটকাতে হবে। তার সঙ্গে ডিম ভাল করে ফেটিয়ে দিতে হবে। ভাল করে দু’টিকে মেশাতে হবে। মিশ্রণে পেঁয়াজকুচি ও লঙ্কাকুচি, ইচ্ছে হলে আদাবাটা দেওয়া যেতে পারে। নুন, মিষ্টি ও সামান্য হলুদ দিয়ে খুব ভাল করে ফেটাতে হবে। গোটা জিনিসটাকে ভাপে বসাতে হবে। ঠান্ডা হলে টুকরো করে কাটতে হবে। ছাঁকা তেলে ভাজতে হবে। কোপ্তায় রং আনার জন্য কড়াইয়ের গরম তেলে চিনি দিয়ে রং করতে হবে। তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে আদাবাটা, হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, নুন, মিষ্টি ও টক দই দিয়ে ভাল করে ফোটাতে হবে। ধোঁকাগুলো দিতে হবে। ঘি-গরমমশলা দিয়ে নামাতে হবে।তখনকার দিনে রান্নাঘর থেকে ঘি-গরমমশলার গন্ধে বোঝা যেত নানা পদের স্বাদ। ছেলেমেয়েদের স্কুলে টিফিন বা রবিবারের লুচির পাতে হালুয়ার রীতি ছিল। সেই সময় ডালডা বা সাদা তেলে আমাদের বাড়িতে হালুয়া হত না, হত ঘি দিয়ে। কড়াইয়ে ঘিয়ের মধ্যে তেজপাতা, মৌরি দিয়ে তা সামান্য বাদামি হলে তাতে সুজি দিয়ে ভাজা ভাজা করতে হবে। সুজির সমপরিমাণ চিনি দিয়ে আরও ভেজে জল দিতে হবে। কোনও সময় তা থকথকে, কোনও সময় ঝুরঝুরে হবে। যেমন পছন্দ তেমন খাওয়া।
আমি সতেরো বছর বয়সে শোভাবাজার-বেনিয়াটোলার দিনু রক্ষিত লেনের বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছি। তখন কিছুই জানতাম না। বাবা-কাকারা ছিলেন সাত ভাই। যৌথ সংসারের খাওয়াদাওয়া ছিল রান্নার ঠাকুরের উপরে। সে ভাবে শেখার সুযোগ হয়নি। পরে খেতে খেতে রান্না শিখি। ৬০ বছর হল সংসার করছি। বর্তমানে রাজবল্লভপাড়া-য় থাকি। বিয়ের পরে বাড়িতে আমি পেয়েছিলাম শ্বশুরমশাই, শাশুড়িমা ও বড় জাকে। সঙ্গে পেয়েছিলাম ভাসুর ও দুই দেওরকে। একটি বাচ্চাও ছিল। ধীরে ধীরে বাড়ি ভরে উঠল। ঠাকুরবামুনেরাই রান্না করতেন। স্বামী অনাদিনাথ দাঁ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও পরীক্ষা-নিয়ামক। পড়াশোনা ছিল বিজ্ঞান নিয়ে। নানা মানুষ আসতেন বাড়িতে। মনে পড়ছে দু’জন সাহেব-সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনা কুড়ি লোকজনে বাড়ি বেশ জমজমাট হয়েছিল। এ রকম প্রায়ই হত। সাহেবদের আসার কথা বেশ মনে আছে। শাশুড়িমায়ের নির্দেশে মাংস, চিংড়ির মালাইকারি, দইপোনা, পোলাও, সাদাভাত, কয়েকটা নিরামিষ পদ ও মিষ্টি ছিল। সব খাবার দেওয়া হয়েছিল রুপোর থালা-বাটিতে এবং জল ছিল রুপোর গেলাসে।
আমার স্বামীর প্রিয় ছিল পোস্তর নানা রান্না, মোচার কাটলেট, পুঁই-মেটে চচ্চড়ি। তবে জানিয়ে রাখি পোস্ত বাটার সময় যদি সামান্য নুন মিশিয়ে নেওয়া যায় তবে স্বাদ একটু অন্য রকম হবে। পুঁই-মেটে চচ্চড়ি রাঁধতে হলে মেটে কেটে ছোট ছোট টুকরো করে সাদা জলে সেদ্ধ করতে হবে। কড়াইতে পাঁচফোড়ন ও শুকনো লঙ্কা দিয়ে তাতে আলু, বেগুন, কুমড়ো কেটে ভাল করে কষতে হবে। পুঁই শাক ও মেটে দিয়ে আরও কষে তাতে নুন, মিষ্টি ও হলুদ দিতে হবে। শুকনো করে নামিয়ে নিতে হবে। আসলে এ সব রান্না করতে গেলে ধৈর্যেরও দরকার আছে।
বাড়িতে অতিথি এলে কিংবা জলখাবারের প্লেটে মোচার কাটলেট মন কাড়ে।
এখনকার ব্যস্ত জীবনে মোচা, থোড় প্রায় বাদ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ সব দিয়ে কাটলেট বা চপ দিলে একটিও পাতে পড়ে থাকবে না। মোচা সেদ্ধ করে জল ফেলে দিতে হবে। সঙ্গে বেসন দিয়ে মেশাতে হবে। কড়াইতে তেল দিয়ে মাখা মোচা, আদাবাটা, জিরেবাটা, লঙ্কাবাটা, গরমমশলা ও নুন-মিষ্টি দিয়ে কষে কাটলেটের আকার করতে হবে। বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে বেসনে ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজতে হবে।
একটা সময় ছিল যখন আগের দিন থেকে ঠিক করা হত বাজার থেকে কী কী আসবে। অবশ্য বাজার করার দায়িত্ব যাঁর থাকত তিনি অতি নিপুণ ভাবে কাজটি সম্পন্ন করতেন। সকাল থেকে রান্নাঘরে তোড়জোড় পড়ে যেত। হরেক পদের রান্না। নিরামিষ রান্না আগে হতো। এখন আরও বেশি হয়। একটি পদ জানাই, লাউকোপ্তা। লাউ ঘষে জল ফেলে দিতে হবে। এর সঙ্গে ময়দা বা বেসন দিয়ে নুন, মিষ্টি, হলুদ ও হিং দিয়ে ভাল করে চটকে মণ্ড তৈরি করে ছাঁকা তেলে ভাজতে হবে। কড়াইতে জিরে ও তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে তাতে আদাবাটা, জিরেবাটা, টক দই, নুন, মিষ্টি সহ ফুটিয়ে মণ্ডগুলো দিয়ে ঘি ও গরমমশলা দিয়ে নামাতে হবে।

পদগুলি তৈরি করেছে ‘ওহ্! ক্যালকাটা’
ছবি: শুভেন্দু চাকী
Previoius Story

Kolkata

Next Item




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.