ব্যাগ গুছিয়ে...

অচেনা আদরের খোঁজে
ন এইচ-২ ধরে আমার বাসটা যখন ছুটছে, তখনও সকালের আকাশের গুমোর কাটেনি। কী যে হয়েছে ওর কে জানে! এমন আকাশ আমার একটুও ভাল লাগে না। কালো অ্যাসফল্টের রাস্তায় আঁকা সাদা লেন-মার্কগুলো কেমন হঠাৎ করে বাসের সামনে এসেই হারিয়ে যাচ্ছে বাসের পেটের তলায়। রাস্তার দু’ধারে আর ডিভাইডারে লাগানো ম্যাজেন্টা রঙের বোগেনভিলিয়া আর গোলাপি-সাদা ফুরুসরা হাওয়ার সঙ্গে মশকরায় মেতেছে, অকারণেই হেসে লুটিয়ে পড়ছে এ-ওর গায়ে। জারুলের ফোটা ফুলগুলো জ্যৈষ্ঠ-শেষের বার্তা দিচ্ছে।
বাস আমায় নামিয়ে দিয়ে গেল পানাগড় বাজার-শেষে দার্জিলিং মোড়ে। সেখান থেকে আর একটা বাস ধরে মাতুরিয়া পার হয়ে ইলামবাজারের পথে। এগারোমাইলের মোড়ে নেমে হাঁটা দিয়েছি। বেশ কিছুটা চলার পরে এক সাইকেলে-বসা মানুষ পিছন থেকে আমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে সাইকেল থামালেন। গন্তব্য জানার পরে সাদর আমন্ত্রণ‘উইঠ্যে বইসেন পিছনে, একটুক আগাই দিই বট্যে...।’ আহা, এ তো না চাইতেই আকাশের চাঁদ! উঠে বসি।
মিনিট পনেরোর মাথায় আদুরিয়া বনবাংলোয় যাওয়ার লাল মাটির মোরাম পথ। আকর্ণ হাসিতে দুজনে দুজনকে বিদায় জানাই।
মোরাম পথ ধরে এগিয়ে চলি বনবাংলোর দিকে। পান্না-সবুজ এক চিলতে সবুজ জল বুকে নিয়ে গাঁয়ের ছোট্ট পুকুরটা পাড়ের গাছেদের সঙ্গে দেয়ালা করছে। পাশের ছোট ইস্কুলটায় সবে প্রার্থনা শেষ হল। সদ্য বড় হয়ে ওঠা গ্রামের মেয়েটা শাড়িতে গা ঢেকে তার নতুন ভালবাসাকে শাসন করতে যেমন ব্যস্ত, তেমনই ব্যস্ত তার পোষা ছাগলগুলো নিয়েও। মোরামে ঢাকা পথের দু’পাশে শাল, সেগুন, পলাশ, অর্জুন আর ইউক্যালিপটাসের ‘গার্ড অব অনার’ নিতে নিতে আদুরিয়া বনবাংলোর হাতায় এসে পড়লাম। এখানে ট্যুরিস্ট খুব একটা বোধহয় আসে না। তবে আজ তার অপেক্ষার অবসান। আমি এসেছি। প্রতি পদক্ষেপে শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ...অজস্র প্রজাপতি লুকোচুরি খেলছে রঙ্গন, গোলাপের ঝোপে...ছাতারে, পার্পল সান বার্ড, বাঁশপাতি, টুনটুনি, বুলবুলিদের কথা যেন আর ফুরোতেই চাইছে না...একটা টুনটুনি তার বাসা নিয়েই ব্যস্ত...ঝিঁঝিঁগুলো অবিরাম শব্দ করে চলেছে...যেই কাছে যাচ্ছি, অমনি সব চুপ!
আদুরিয়ার অদূরেই কিছু সাঁওতাল গ্রাম আছে। আমজারুলিয়া তাদের মধ্যে সব থেকে কাছেই। জঙ্গলের পথ ধরে পায়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাই সেখানে। বড় ভাল মানুষগুলো। ইচ্ছে থাকলে গ্রামপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে তাঁর ব্যবস্থাপনায় সাঁওতালদের নাচও দেখা যেতে পারে। না হলে তিন-সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারেন কালিকাপুরে। এখানে বর্ধমান রাজার দেওয়ানজির প্রাসাদের ভগ্নাবশেষে নিজেকে ‘খন্ডহর’ ছবির নায়ক মনে হতে পারে। আপত্তি কীসের! এখন এখানে নানা ছবির শুটিং হয়। কালিকাপুরের গ্রামে আপনাকে স্বাগত জানাবে তার ছায়াঘেরা পুকুরঘাট, টলটলে জলে গা-ভাসানো হাঁসেরা, কুর্চি ফুলের মিষ্টি গন্ধ আর অবশ্যই সরল মানুষগুলো। সন্ধ্যায় ফেরার পথে ইউক্যালিপটাস আর শালের জঙ্গলের হাওয়া মন জুড়োবে।
পরের দিন সকাল সকাল এগারোমাইল মোড় হয়ে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে দেউল, ইছাইগড়ের ধারে। এখানে বিস্তীর্ণ বালির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে অজয় নদ। বর্ষায় নতুন রূপ নিয়েছে। ও পারে জয়দেবের কেঁদুলি। এ পারে বসে থাকতে থাকতেই বাউল-মন ভেসে যায় জলের স্রোত ধরে কোনও অজানা-অচেনা দিকশূন্যপুরে।
ফিরছি যখন শরীরে-মনে আদুরিয়ার আদর মেখে, তখনই আকাশ সাজতে বসেছে। জঙ্গলে হাওয়া বইছে...মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া...শালগাছেরা গায়ে গা ঘষছে...অদ্ভুত এক শব্দ...শুকনো পাতারা উড়ে এসে আমায় যেন ঢেকে দিতে চাইছে...জঙ্গলের ছোট বড় সব গাছেদের মাঝে আমিও যেন একটা গাছ হয়ে গেছি...আদুরিয়ার জঙ্গলে তাদের মতোই আমিও জ্যৈষ্ঠের প্রখর রোদের পরে বৃষ্টির পালাগান শোনার অপেক্ষায়..
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে পানাগড় ট্রেনে। পানাগড় থেকে আদুরিয়া প্রায় ২০ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। ধর্মতলা থেকে এক্সপ্রেস বাসে পানাগড় দার্জিলিং মোড়ে নেমে, সেখান থেকে ইলামবাজারের পথে অন্য বাসে এগারোমাইলের মোড়ে নেমে রিকশায় অথবা হেঁটে দেড় কিলোমিটার দূরে আদুরিয়া। আদুরিয়া থেকে দেউল যাওয়ার জন্য এগারোমাইলের মোড় থেকে ভ্যান রিকশা অথবা গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
আদুরিয়ায় থাকার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটিই বনবাংলো।
কখন যাবেন
সারা বছরই যাওয়া যায় দিন-দুয়েকের বিশ্রাম নিতে। তবে জ্যৈষ্ঠে কিন্তু বেশ গরম।
Previous Story

Kolkata

Next Item




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.